• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মানবদেহের অর্ধেকই মানুষ নয়!

  • তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ১২ এপ্রিল ২০১৮

এতদিন আমাদের জানা ছিল মানবদেহ হলো একটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ দেহ কাঠামো- যা মাথা, ঘাড়, ধড়, বাহু, হাত, পা ও পায়ের পাতা। মানবদেহের প্রতিটি অংশই বিভিন্ন ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত। এগুলোকে সাধারণ ভাষায় বলা হয় মানবকোষ। আর এই কোষগুলো গঠিত কার্বন, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মতো বেশ কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের সমন্বয়ে। পরিণত অবস্থায় মানবদেহের কোষের সংখ্যা থাকে গড়ে প্রায় ৩৭ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন। কোষের এই সংখ্যা শুধু মানুষের নিজেরই নয় বরং মানবদেহে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, আর্কিয়া এবং মেথানোজেন্সের সংখ্যাও এতে অন্তর্ভুক্ত। মানবদেহের পাকস্থলী, পরিপাকনালি, ত্বক ও শরীরের অন্যান্য অংশে অবস্থিত সব অণুজীবের সংখ্যাকে একত্রে বলা হয় হিউম্যান মাইক্রোবায়োম। কিন্তু একজন মানুষের শরীরে মানবকোষ ও মাইক্রোবায়োমের অনুপাত কত তা ছিল অজানা।

তবে মানবদেহে মানবকোষ ও মাইক্রোবায়োমের অনুপাত নিয়ে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন পরিণত মানুষের শরীরের মাত্র ৪৩ শতাংশ মানবকোষ দিয়ে গঠিত। বাকিটা ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়া, এবং মেথানোজেন্সের মতো পরজীবীর কোষ- শরীর। অর্থাৎ মানুষের শরীরের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের নয়!

গবেষকরা বলছেন, মানুষের শরীরে যে মাইক্রোবায়োম আছে তা অবশ্যই মানুষের জন্য উপকারী। তাই সেগুলোকে পরজীবী বা অনুপ্রবেশকারী মনে হয় না। মানব শরীরের এই গোপন সত্যটি আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, অ্যালার্জি রোগটি কী করে পারকিনসন্সের মতো রোগে রূপান্তরিত হয় তা জানা যাবে।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োম বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক রুথ লি বলেন, নতুন পাওয়া এই তথ্য মতে আপনার শরীরটি শুধু আপনার নয়। তবে আপনার শরীরে আর যারা আছে তারা কিন্তু ক্ষতিকর নয়।

আর এ কারণেই হয়তো আমাদের শরীর যতভাবেই ধোয়া হোক বা পরিষ্কারের চেষ্টা করা হোক, মাইক্রোবায়োমগুলো থেকেই যায়।

ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রব নাইট বিবিসিকে বলেন, নতুন পাওয়া তথ্য এটাই বলে, আপনি একজন মানুষের তুলনায় অনেক বেশিই অণুজীবীয়।

তিনি বলেন, আগে মনে করা হতো মানবদেহের বেশিরভাগই মানবকোষ। আর সে সংখ্যা মাইক্রোবায়োমের অনুপাতে ১০ গুণেরও বেশি। তবে নতুন আবিষ্কার বলছে, শরীরে মানবকোষের তুলনায় মাইক্রোবায়োমের সংখ্যাই বেশি।

একজন মানুষের শরীরের পুরো একসেট জেনেটিক ইনট্রাকশন সাধারণত ২০ হাজারের বেশি জিন নিয়ে গঠিত। তবে মাইক্রোবায়োমের জিনের সংখ্যা মিলে মানব শরীরের মোট জিনের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই কোটির বেশিতে।

ক্যালটেকের অণুজীববিদ সার্কিস ম্যাজমেনিয়া বলেন, আমাদের কেবল একটি জিনোম নয়। মাইক্রোবায়োমের জিনোমগুলোও আমাদের শরীরেরই জিনোম। সেগুলো মানব জিনোমের মতোই কাজ করে।

তার মতে, একটি মানব শরীর হলো মানুষের নিজের ডিএনএ ও মাইক্রোবায়োমের ডিএনএ’র সমন্বয়।

মাইক্রোবায়োমের প্রয়োজনীয়তা

গবেষকরা ধীরে ধীরে মাইক্রোবায়োমের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন। মাইক্রোবায়োমগুলো আমাদের হজম, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণসহ অত্যাবশ্যকীয় কিছু ভিটামিনও উৎপাদন করে শরীরের ভেতরেই।

এ ছাড়া মানুষের দেহে থাকা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা মৃত্যুর সময় এবং অপরাধবিষয়ক অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। কোনো মানুষ জরায় আক্রান্ত হওয়ার পর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা মানুষটির আয়ু সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।

সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, মাইক্রোবায়োম বা দেহের কোনো অংশে জীবাণুর বসবাসের অবস্থা বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যাবে ওই দেহের মৃত্যুর সময় কখন ঘনিয়ে আসতে পারে।

তা ছাড়া এই গবেষণাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে নেক্রোবায়োম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া য়ায়। নেক্রোবায়োম হলো মৃতদেহে জীবাণুর নমুনা। নেক্রোবায়োম মৃতদেহ দখলের জন্য কতটা সময় নেওয়া হয় তার হিসাব করে ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা মৃত্যু এবং অপরাধ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও ধারণা পাবেন। আরো কিছু গবেষণা ও পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে মাইক্রোবায়োমভিত্তিক পদ্ধতির বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর দিনক্ষণ হয়তো জানা যাবে।

মাইক্রোবায়োম ধ্বংস করবেন না!

মানবদেহের মাইক্রোবায়োমের মধ্যে এক হাজার প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আছে এবং তাদের প্রত্যেকটি আপনার শরীরের একটি ভিন্ন ভূমিকা পালন করে। তাদের বেশিরভাগই স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিছু ব্যাকটেরিয়া যেগুলো শিশুদের মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করে, সেগুলো বিফিড ব্যাকটেরিয়া। তারা দুধের সুস্বাস্থ্যের সুগারগুলোকে হ্রাস করে, যা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কিছু ব্যাকটেরিয়া আবার ফাইবার ডাইজেস্ট করে, শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড উৎপাদন করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফাইবার ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, হূদরোগ এবং ক্যানসারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া ইমিউন কোষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনার শরীরে সংক্রমণ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

মাইক্রোবায়োমের ভেতরে কিছু ব্যাকটেরিয়া ধমনিতে বাধা দিতে পারে এবং হূদরোগে আক্রান্ত হতে পারে এমন রাসায়নিকগুলো তৈরি করতে পারে। যাই হোক, প্রোবায়োটিকগুলো নিম্ন কোলেস্টেরল এবং হূদরোগের ঝুঁকিতে সাহায্য করতে পারে। এটি রক্তের চিনিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।

কিন্তু বর্তমানে আমরা যে হারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছি তাতে হুমকির মুখে পড়েছে এইসব মাইক্রোবায়োম। অ্যান্টিবায়োটিকের বার বার ব্যবহার ব্যাকটেরিয়ার জন্মে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে সুগঠিত মাইক্রোবায়োম তৈরিই হয় না দেহে। আর এর প্রভাব পড়ে পুরো মানবদেহের গঠনে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads