• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

প্রতীকী ছবি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সময় কেবল সামনেই যায় কেন?

  • প্রকাশিত ১৬ এপ্রিল ২০১৮

আদিমকালে মানুষ বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় বাস করত। বনের জীবজন্তু শিকার করে খেত। সেই সময় মানুষের কাজকর্মের জন্য ঘড়ির প্রয়োজন ছিল না। সূর্য উঠলে দিন শুরু, আর ডুবে গেলে হয় রাত।

পরে মানুষ আরো বুঝতে শিখল। তারা দেখল প্রতিদিন সূর্য একটা নির্দিষ্ট পথে চলাচল করে। সেই থেকে মানুষ সূর্যের উদয় আর অস্ত যাওয়া থেকে সময়ের হিসাব করা শিখল। এরপর তারা দেখল, সূর্যের আলোতে ছায়া পড়লে তা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কখনো স্থির থাকে না। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছায়াও সরে যায়। মানুষ তখন মাটিতে কোনো বস্তুর ছায়ার বিভিন্ন অবস্থান চিহ্নিত করতে লাগল। মাটিতে দাগ কেটে কিংবা পাথর সাজিয়ে ছায়ার চিহ্ন রাখা হতো। সাধারণ এই পদ্ধতিটির উদ্ভাবন থেকেই মানব ইতিহাসে প্রথম ঘড়ির জন্ম হলো।

তারপর আস্তে আস্তে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে নানা ধরনের ঘড়ির আবির্ভাব হতে থাকে। সেই প্রাচীনকালের সূর্যঘড়ি থেকে আজকের আধুনিক স্মার্টওয়াচ। মাঝে সময়ের প্রবাহ বা রাত-দিন ও বছর কেন হয় সেই ব্যাখ্যাও মিলেছে।

রাত-দিন নিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রচলিত মিথের বদলে এখন আমরা জানি দিন থেকে রাত হওয়া বা আবার দিন হওয়া, বছর ঘুরে বছর আসার ঘটনার পেছনে রয়েছে আসলে গতি। পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণনকে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বলে। এই গতি পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত অভিমুখে হয়ে থাকে। এর ফলেই পৃথিবীর একপাশে রাত হয় আরেক পাশে হয় দিন।

আবার পৃথিবী নিজ অক্ষের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতেই উপবৃত্তাকার পথে একবার সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসে। আপন কক্ষপথে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে পৃথিবীর এই পরিক্রমণকে বার্ষিক গতি বলে। এই কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে লাগে ৩৬৫ দিন। পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে ঋতু পরিবর্তন ঘটে এবং দিন-রাত্রি ছোটবড় হয়।

তবে সময়কে এসব জ্ঞান ও আবিষ্কারের পর আজও সময়ের বয়ে চলাতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। সামর্থ্য নেই যে সময় একবার পেছনে যায় তাকে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু কেন এমন হয়? সময় কেন পশ্চাৎমুখী নয়?

প্রশ্নটির উত্তরের আগে কল্পনার রাজ্যে একটু ঘুরে আসার নিমন্ত্রণ।

ধরুন, আপনি একটি সিনেমা দেখছেন। সিনেমার একটি দৃশ্যে একটি ডিম খোসা ভেঙে ফ্রাই প্যানে তেলে ভেজে অমলেট করার দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। হঠাৎ ইচ্ছা হলো আপনি সেই দৃশ্যটি রিওয়াইন্ড করে দেখবেন। আপনি রিওয়াইন্ড বাটনে চাপলেন এবং সেই দৃশ্যটির উল্টো দৃশ্য দেখলেন। ডিমটি অমলেট থেকে আস্তে আস্তে আগের আকার ফিরে পেল এবং শেষে খোসাটা জোড়া লেগে গেল এবং ডিমের কুসুমসহ সাদা অংশ সেই খোসার ভেতরে ঢুকে গেল। অর্থাৎ আপনি একটি ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আবার শুরুতে নিয়ে গেলেন।

আবার কল্পনা করুন, পৃথিবীতে সময় এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা সামনে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। মানুষ সামনে যাওয়ার পরিবর্তে পেছনে যাচ্ছে। তখন বয়স না বেড়ে বরং কমে যাচ্ছে। মানুষ বয়স্ক অবস্থায় জন্ম নিচ্ছে এবং আস্তে আস্তে তাদের বয়স কমে তারা ছোট হয়ে যাচ্ছে, সমস্ত জানা জিনিস ভুলে যাচ্ছে এবং একটা সময় একদম ছোট্ট অবস্থায় বাবা মায়ের কোলে শুয়ে চোখ শেষবারের জন্য বন্ধ করে নিচ্ছে।

 

উল্লেখিত দৃশ্যকল্প দুটির মধ্যে মাঝে প্রথমটি খুব স্বাভাবিকভাবে হলেও পরেরটি একেবারে অবাস্তব! কারণ আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যেখানে সময় কখনো পিছিয়ে যায় না। কিন্তু কেন সময় কখনো পেছনে যায় না? কেন সময় শুধু সামনেই এগিয়ে যায়? কেন আমরা শুধু অতীতকালের কথাই মনে করতে পারি, ভবিষ্যতের কথা কেন মনে করতে পারি না?

পদার্থবিদ্যার প্রতিটি সূত্র সময়ের সঙ্গে প্রতিসম। অর্থাৎ সূত্রগুলো সময় সামনে এগোলো নাকি পেছনে গেল এর ওপর নির্ভর করে না। যেমন, স্যার আইজাক নিউটনের গতি এবং মহাকর্ষ বিষয়ক সূত্রগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন সাধারণ-অসাধারণ ঘটনাবলিকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। আমরা জানি, প্রতিটি ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমরা জানি, কেন আপেল নিচে পড়ে এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। কিন্তু একটু চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাব এই সূত্রগুলো সময় এগিয়ে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া- উভয় ক্ষেত্রেই খুব নিখুঁতভাবে কাজ করে।

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মতে আমরা জানি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু একটা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় যাচ্ছে। এই একটি মাত্র সূত্র যা কোনো কিছুর পেছনে যাওয়াকে সমর্থন করে না। এই সূত্রটির জন্য আমরা পেছনে গিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারি না। এই বিশৃঙ্খল অবস্থাকে বোঝানোর জন্য পদার্থবিদ্যায় যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে এনট্রপি।

যদি আমরা কোনো সিস্টেমে যেকোনো শক্তিকে ব্যবহার করে কাজে রূপান্তরিত করতে চাই, তাহলে আমরা পুরো শক্তিকে রূপান্তরিত করতে পারব না। কিছু অংশ পরিবেশ বা সিস্টেম কর্তৃক শোষিত হবে বা হারিয়ে যাবে। এই শোষিত বা হারিয়ে যাওয়া শক্তির পরিমাণ হচ্ছে এনট্রপি। অর্থাৎ এটি যেহেতু একটি বিশৃঙ্খলতা, তাই অন্যভাবে  বলা যায় এই বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিমাপই হচ্ছে এনট্রপি।

মূলত কোনো সিস্টেমের শক্তি রূপান্তরের অসম্ভবতাকে এনট্রপি বলে। যদি দুটি বস্তুর মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে তাহলে বেশি তাপমাত্রার বস্তু থেকে কম তাপমাত্রার বস্তুতে তাপশক্তি প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে শক্তির রূপান্তর সম্ভব হয়। এক সময় দুটি বস্তু তাপের আদান-প্রদানের ফলে সাম্যাবস্থায় এসে পড়ে। সাম্যাবস্থায় এনট্রপি সবচেয়ে বেশি হয়। আর তাপ একবার সুস্থিত হলে তা অস্থিতিতে রূপান্তর হয় না। কারণ তাপীয় সাম্যাবস্থা রিভারসিব নয়। সেখান থেকে আর শক্তি রূপান্তর সম্ভব হবে না।

সময়ের দিক ব্যাখ্যার জন্য এনট্রপি খুব ভালো একটি ধারণা। আমরা এখন জানি সময় কেন সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এখন বুঝতে পারি, সর্বজনীন একটি সময় আছে। কিন্তু একই সঙ্গে একটি প্রশ্ন উঠে আসে। এই সর্বজনীন সময়ের শুরু আসলে কখন থেকে বা কোন ঘটনা থেকে। এই প্রশ্নের জবাবও এখন আমরা এনট্রপির ধারণা যদি ভালোভাবে বুঝে থাকি, তবে খুব সহজেই দিতে পারি। যখন এনট্রপি আসলে শূন্য ছিল অর্থাৎ সৃষ্টির শুরুতেই যখন বিগ ব্যাং (এক মহাবিস্ফোরণ) হলো, ঠিক তখন থেকেই সময়ের বয়ে চলা শুরু হয়েছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সময় সামনের দিকেই বয়ে চলেছে আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজগৎও সম্প্রসারিত হয়েই যাচ্ছে।

প্রতিটি জিনিসের শুরু এবং শেষ উভয়ই যদি থাকে, তাহলেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে সময়ের শেষ কবে? অর্থাৎ কবে সময়ের সামনের দিকে বয়ে চলা শেষ হবে? সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, যখন এনট্রপি একদম চূড়ান্ত মান গ্রহণ করবে অর্থাৎ বিশ্বজগৎ সর্বোচ্চ বিশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছাবে। এই অবস্থা কিছু বিশেষ ব্যাপারের ওপর নির্ভর করছে। আমাদের গ্যালাক্সির প্রধান একটি গাঠনিক উপাদান হচ্ছে ডার্ক এনার্জি। এই ডার্ক এনার্জি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই হারে বাড়তে থাকলে হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে একদিন বিশ্বজগৎ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বিগ রিপ বিস্ফোরণে। আবার ডার্ক এনার্জি যদি কোনো কারণে কমে যেতে যেতে একদম শূন্যের কাছাকাছি হয় তবে বিগ ব্যাং এর উল্টো বিগ ক্রাঞ্চ হতে পারে। এমনও হতে পারে বিশ্বজগৎ আজীবন সম্প্রসারিত হতেই থাকবে। আবার এমনও হতে পারে ডার্ক এনার্জির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে আরেকটি নতুন বিগ ব্যাং হতে পারে। তখন আমাদের এই পরিচিত সময় শেষ হয়ে নতুন সময় শুরু হতে পারে।

আমাদের মহাবিশ্বের এনট্রপি ক্রমাগত বেড়েই চলছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুর দিকে এনট্রপি ছিল ১০^৮৮। বর্তমানে মহাবিশ্বের এনট্রপি হচ্ছে ১০^১০১। এখন পর্যন্ত জানা মতে মহাবিশ্বের এনট্রপি সর্বোচ্চ হবে ১০^১২০। তখন আর মহাবিশ্বের কোথাও কোনো শক্তির রূপান্তর সম্ভব হবে না। এনট্রপি সর্বোচ্চ হওয়ার মধ্য দিয়ে সময় এরও পরিসমাপ্তি ঘটবে।

-ইন্টারনেট অবলম্বনে তপু রয়হান

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads