• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ক্ষুদ্র উৎস থেকে বিপুল শক্তির রহস্য

  • তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০১৮

ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের শুরু সময়ে যখন ‘শিল্প বিপ্লব’ হলো, তখন প্রায় হঠাৎ করেই শক্তির প্রয়োজনীয়তা হয়ে উঠল আকাশচুম্বী। শিল্প-কারখানার দ্রুত উন্নয়ন ও কারখানার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে দেখা দিল প্রচুর শক্তির প্রয়োজনীয়তা। যেখানে শিল্প বিপ্লবের আগে মানবসভ্যতায় প্রাকৃতিক এবং নবায়নযোগ্য শক্তি কাজে লাগালেই চলত, সেখানে শক্তির প্রয়োজনীয়তায় উদ্ভাবিত হলো একের পর এক কয়লা, তেল, গ্যাস ইত্যাদি খনিজ শক্তির উৎস।

বর্তমান পৃথিবীতে যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন হচ্ছে এবং এর জন্য যে হারে জীবাশ্ম জ্বালানি কাজে লাগানো হচ্ছে, তাতে মনে করা হচ্ছে ভূগর্ভে সঞ্চিত উত্তোলনযোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানি এই শতকেই শেষ হয়ে যাবে। এতে দেখা দেবে তীব্র জ্বালানি ও শক্তিসঙ্কট। এই সঙ্কট কাটাতে দুটি উত্তম শক্তির উৎসের দিকে নজর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এক. পারমাণবিক শক্তি এবং দুই. প্রাকৃতিক ও নবায়নযোগ্য শক্তি।

তবে আজকের নিবন্ধে পারমাণবিক শক্তির উৎপাদন নিয়ে আলোচনা করা হবে। ফ্রান্সের পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেল সর্বপ্রথম ১৮৯৬ সালে পারমাণবিক শক্তি উদ্ভাবন করেন। তিনি অন্ধকারে ইউরেনিয়ামের পাশে রক্ষিত ফটোগ্রাফিক প্লেটের বর্ণ পরিবর্তন দেখে এই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হন।

সাধারণত নিউক্লীয় ফিউশন বা ফিশন বিক্রিয়ার ফলে এই শক্তির উদ্ভব ঘটে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভর হতে শক্তির রূপান্তর অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের E = mc2 শক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে E = উৎপন্ন শক্তি, m = শক্তি উৎপন্নকারী পদার্থের ভর এবং c = আলোর গতিবেগ (শূন্য মাধ্যমে)। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে কোনো বস্তু যখন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, শক্তির পরিমাণ হয়ে দাঁড়ায় ভরের সঙ্গে আলোর গতির বর্গের গুণফলের সমান!

অর্থাৎ ভর অতি ক্ষুদ্র হলেও যখন তার সঙ্গে আলোর বেগের বর্গ যুক্ত হয় তখন আর তা অল্প থাকে না। ভর থেকে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অতি অল্প পদার্থকেও যদি শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয় সেখান থেকে পাওয়া যায় অকল্পনীয় পরিমাণে শক্তি। এই তো গেল কীভাবে অতি অল্প ভর থেকে বিপুল শক্তি পাওয়া যেতে পারে তার গাণিতিক ধারণা।

এখন দেখার চেষ্টা করা যাক ঠিক কী প্রক্রিয়ায় ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।

পারমাণবিক বিক্রিয়া

ফিশন বিক্রিয়া (Fission Reaction)

মূলত ভারী মৌল ভেঙে হালকা মৌলে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকেই ফিশন বিক্রিয়া বলা হয়।

কোনো ভারী মৌলের নিউক্লিয়াসে যদি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয় তখন সেটি উত্তেজিত হয়ে ভেঙে দুটি তুলনামূলক হালকা মৌলে পরিণত হয়। এ সময় কিছু নিউট্রন বিচ্ছিন্নভাবে নির্গত হয়। দেখা যায় প্রাথমিক ভারী মৌলের পরমাণুর ভর অপেক্ষা নতুন সৃষ্ট দুটি মৌলের পরমাণু ও অতিরিক্ত নিউট্রনের ভরের যোগফল কিছুটা কম। অর্থাৎ ভারী মৌল ভেঙে হালকা মৌলে পরিণত হওয়ার সময় কিছুটা ভর হারায়। এই হারানো ভরই ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র অনুযায়ী শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, তাপ ইত্যাদি রূপে ছড়িয়ে পড়ে।

এই পদ্ধতিকে কেন্দ্র করেই ইউরেনিয়ামের মতো ভারী ধাতবকে কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক চুল্লিতে (Nuclear Reactor) শক্তি সংগ্রহ করা হয়।

শৃঙ্খল বিক্রিয়া (Chain Reaction)

এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে একটি পরমাণুতে একটি নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হলে বিক্রিয়া শেষে তিনটি মুক্ত নিউট্রন থেকে যাচ্ছে। এই নিউট্রনগুলো কী করছে? সেগুলো তার গতিশক্তির কারণে পার্শ্ববর্তী পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আঘাত করছে অর্থাৎ আরো তিনটি পরমাণুতে একই বিক্রিয়া ঘটছে। সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৯টি নিউট্রন। এভাবে একবার পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু করে দেওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা চলছে এবং বর্গীয় অনুপাতে পরমাণু ভাঙছে ও শক্তি নির্গমনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা ঘটছে অতীব দ্রুত।

এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন রিঅ্যাকশন। এই চেইন রিঅ্যাকশনের ওপর ভিত্তি করেই গঠিত পারমাণবিক চুল্লিগুলো।

ফিউশন বিক্রিয়া (Fusion Reaction)

ফিউশন বিক্রিয়া মূলত ফিশন বিক্রিয়ার ঠিক উল্টো প্রক্রিয়া। এক কথায় বললে ফিশনে ভারী মৌল ভেঙে একাধিক হাল্কা মৌল তৈরি করে আর ফিউশনে একাধিক হাল্কা মৌল মিলিত হয়ে তৈরি করে তুলনামূলক ভারী মৌল।

সাধারণত দুটি হালকা ভিন্ন মৌল বা একই মৌলের একাধিক পরমাণু বা একই মৌলের একাধিক আইসোটোপ মিলিত হয়ে তুলনামূলক ভারী মৌল গঠন করে এবং ফিশন বিক্রিয়ার মতোই কিছুটা ভর-শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই পারমাণবিক বিক্রিয়াকেই বলা হয় ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়া প্রধানত সূর্যসহ অন্যান্য নক্ষত্রে ঘটে থাকে। নক্ষত্রে তাপ-পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম, হিলিয়াম থেকে কার্বন এবং কার্বন থেকে লোহা পর্যন্ত উৎপন্ন হয় নক্ষত্রের আকার ও ভরের ওপর নির্ভর করে।

হাইড্রোজেনে প্রধানত তিন ধরনের আইসোটোপ বেশি দেখা যায়- প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম।

পারমাণবিক শক্তি থেকে ফিশন এবং ফিউশন এই দুই উপায়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ফিউশন প্রক্রিয়ায় নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি দিয়ে সারা বিশ্বের বিদ্যুৎ ও অন্যান্য শক্তির জোগান দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন স্বপ্নের মতো ব্যাপার। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে ফিশনের মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশে বহু বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন চলছে। তবে এতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম। যাতে চেরনোবিল, ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনা ঘটে, অত্যন্ত বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি করে, ক্রিটিক্যাল বা মেল্টডাউন বা বিস্ফোরণের মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এমন প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে হয়েছে যার জ্বালানি প্রকৃতিতে সহজলভ্য, নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং উল্লিখিত বিপদগুলো নেই।

তবে ফিউশন প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য এবং ক্রিটিক্যাল বা মেল্টডাউনের মতো ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। বড়জোর ফিউশন বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এটি নিরাপদ। তাছাড়া এর জ্বালানি খুবই সহজলভ্য। সাধারণত ফিউশন রিঅ্যাক্টরে জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়- ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মূলত অন্য সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই। তবে এই কেন্দ্রে অণু-পরমাণুর মাঝে লুকিয়ে থাকা বিশেষ কৌশল ব্যবহার করা হয়।

এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরমাণুকে ভেঙে সেখান থেকে শক্তি বের করে আনা হয়।

আমরা জানি, প্রকৃতিতে চার ধরনের মৌলিক বল আছে। মহাকর্ষ বল, তাড়িতচুম্বক বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল ও সবল নিউক্লীয় বল। এদের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো সবল নিউক্লীয় বল। সবল নিউক্লীয় বলের শক্তি এতই বেশি যে প্রোটনের পারস্পরিক বিকর্ষণকেও কাটিয়ে দিয়ে জোর করে বসিয়ে রাখতে পারে।

কিন্তু সবল নিউক্লীয় বলের বড় ধরনের একটি সীমাবদ্ধতা আছে। এটি খুবই অল্প দূরত্ব পর্যন্ত আকর্ষণ করতে পারে। এর আকর্ষণের পাল্লা খুবই কম। এতই কম যে, বড় আকারের পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে একত্রে রাখতে পারে না। বড় পরমাণুর বড় নিউক্লিয়াসে যদি কোনোভাবে আঘাত করা যায় তাহলে খুব সহজেই এদেরকে ভেঙে একাধিক টুকরো করে ফেলা যাবে। একাধিক টুকরো হলে পরমাণুর আকৃতি কমে আসবে, ফলে সেখানে সবল নিউক্লীয় বল দৃঢ়ভাবে প্রভাব রাখতে পারবে। বড় পরমাণুর বেলায় সবল নিউক্লীয় বলের দুর্বলতাকে ভিত্তি করেই মূলত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা পারমাণবিক বোমা তৈরি করা হয়।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউরেনিয়াম কিংবা প্লুটোনিয়াম মৌল ব্যবহার করা হয়। এ মৌলগুলোর আকার বড় হয়ে থাকে। বাইরে থেকে একটি নিউট্রন দিয়ে যদি এদের নিউক্লিয়াসে আঘাত করে তাহলে নিউক্লিয়াসটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। বিভক্ত হয়ে দুটি মৌল তৈরি করবে। মৌলের পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু নিউট্রনও তৈরি করবে। নতুন দুটি মৌল এবং নতুন তৈরি হওয়া নিউট্রনের ভর একত্রে যোগ করলে মূল ইউরেনিয়াম কিংবা প্লুটোনিয়ামের ভরের সমান হওয়ার কথা। কিন্তু অবাক করা বিষয়- এখানে মূল ভর থেকে পরিবর্তিত ভর সামান্য কম থাকে। এই কম ভরটা হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া ভর আইনস্টাইনের সূত্রানুসারে শক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। এই শক্তিকে ব্যবহার করেই টারবাইন ঘোরানো হয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

পারমাণবিক শক্তির উৎস

ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনের জন্য বিক্রিয়া শুরু হতে যে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় (প্রায় ১ কোটি কেলভিন!) তা নক্ষত্রের কেন্দ্র ব্যতীত অন্য কোথাও তৈরি হওয়া সম্ভব হয় নয়, ফলে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ফিউশন বিক্রিয়া ব্যবহার উপযোগী নয়। তাই ফিশন বিক্রিয়া ও চেইন রিঅ্যাকশনকে কাজে লাগিয়ে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে শক্তি উৎপাদন করা হয় এবং এজন্য ফিশন বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য উপযোগী তেজস্ক্রিয় ও ভারী মৌলগুলো পারমাণবিক শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ ধরনের পদার্থকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।

১. ফিসাইল (Fissile Material) : যেসব মৌল বা আইসোটোপ গতিশক্তিহীন সাধারণ নিউট্রনের সংস্পর্শে এলেই ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয় তাদের Fissile Material বলা হয়। যেমন ইউরেনিয়াম২৩৫ (U235), ইউরেনিয়াম২৩৩ (U233), প্লুটোনিয়াম২৩৯ (Pu239) ইত্যাদি।

২. ফিশনেবল (Fissionable Material) : যেসব মৌল বা আইসোটোপের ফিশন সাধারণ নিউট্রনের সংস্পর্শে সংঘটিত না হলেও উচ্চ গতিশক্তি সম্পন্ন নিউট্রনের আঘাতে শুরু হয় তাদেরকে এই ধারার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সব Fissile Material-কেও এর অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়ে থাকে। যেমন- ইউরেনিয়াম২৩৮ (U238), প্লুটোনিয়াম২৪০ (Pu240) ইত্যাদি।

৩. ফার্টাইল (Fertile Material) : শক্তি আহরণ এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালনা উভয় ক্ষেত্রেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলগুলো হলো Fertile Material। বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় মৌল প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সেগুলো কোনো আরো ভারী মৌলের বিশেষ পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়। এই ‘আরো ভারী মৌল’গুলোকেই বলা হয় Fertile Material। যেমন- দুটি Fertile Materiel থোরিয়াম২৩২ (Th232) এবং ইউরেনিয়াম২৩৮ (U238) থেকে পাওয়া যায় যথাক্রমে দুটি Fissionable Material ইউরেনিয়াম২৩৩ (U233), প্লুটোনিয়াম২৩৯ (Pu239)।

কিছু বিশেষভাবে তৈরি পারমাণবিক চুল্লিতে fertile material ব্যবহার করা হলে ব্যবহূত জ্বালানি আরেকটি Fissionable Material-এ পরিণত হয় যেটিকে পুনরায় সাধারণ পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে দ্বিতীয়বার শক্তি সংগ্রহ করা যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads