• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

ফাইল ছবি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আইনস্টাইন : মহাকালের মহিমান্বিত নকশা হাতে একজন মানুষ

  • কামরুল আহসান
  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০১৮

বলা হয় আইনস্টাইনের জন্মের আগের পৃথিবী আর পরের পৃথিবী এক নয়। হাজার বছর ধরে প্রচলিত জগৎ সম্পর্কে অনেক ধারণা এই একজন মানুষ একা ভেঙে দিয়েছেন। তিনি প্রথম বললেন, আলোর গতিই ধ্রুবক। আলোর চেয়ে গতিশীল আর কিছু হতে পারে না। আলো হচ্ছে বস্তুত শক্তি আর ভরের যোগফল। যেকোনো বস্তুকে আলোর গতিতে ছুড়ে মারতে পারলে তা আলো হয়ে যাবে। প্রতিটি বস্তুকণার ভেতরেই লুকিয়ে আছে অফুরন্ত শক্তি। তার সেই বিখ্যাত সমীকরণ E = mc2, এ যাবৎ কালের বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় সূত্র। বিজ্ঞানের যেকোনো একটি সূত্রও যদি কেউ জানেন তিনি এই সূত্রটিই জানেন। স্টিফেন হকিং তার কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে একটি মাত্র সূত্রই ব্যবহার করেছিলেন, যেন সাধারণ মানুষ বইটি পড়তে পারে, আর সেই সূত্রটিই হচ্ছে এটি। আইনস্টাইনই প্রথম বললেন, সময় স্থানেরই একটি মাত্রা। স্থান ছাড়া সময় নেই। আর সময় ও স্থান আসলে বাঁকা! আপেক্ষিক। এ কথা শোনার পর অনেকেরই ভিরমি খাবার দশা। আপেক্ষিকতাবাদ আবার কী! কথিত আছে আইনস্টাইনের সময়ে মাত্র তিনজন মানুষই এই তত্ত্বটা বুঝতে পেরেছিলেন। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন তাদের মধ্যে একজন। এডিংটনকে যখন জিজ্ঞাস করা হলো, এই তত্ত্বের কী গুরুত্ব আছে যখন আপনিসহ মাত্র তিনজনই মাত্র তত্ত্বটা বুঝতে পারেন। এডিংটন অবাক হয়ে বলেছিলেন, আমি ভাবছি সেই তৃতীয়জন কে? আমি ও আইনস্টাইনের পর এ তত্ত্ব কে বুঝতে পারল!

কেউ বুঝতে না পারলেও আইনস্টাইনের এ তত্ত্ব এতটাই বিখ্যাত হয়ে পড়েছিল যে একশ’জন নাকি এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন, যদি তা ভুলই হতো তাহলে এত মানুষ একসঙ্গে উঠেপড়ে লাগল কেন এর বিরুদ্ধে! আইনস্টাইনকে যখন বলা হলো, আপনি কি একটু সহজ করে তত্ত্বটা বুঝিয়ে দিতে পারবেন? আইনস্টাইন পারলেন। বললেন, ধরুন আপনি একটা সুন্দরী মেয়ের পাশে এক ঘণ্টা বসে আছেন, কিন্তু আপনার মনে হবে আসলে মাত্র ১০ মিনিট গেছে। আর আপনি যদি কঠিন একটা কাজে হাত দেন, ১০ মিনিট কাজ করার পর মনে হবে এক ঘণ্টা চলে গেছে।

আরো কিছু সহজ উদাহরণ আছে এই আপেক্ষিকতাবাদ বোঝার। যেমন একটা চলন্ত জাহাজের ওপর যদি একটা সাইকেল চলতে থাকে তাহলে পাড়ে দাঁড়ানো কারো কাছে মনে হবে সাইকেলটি আসলে থেমে আছে। কিন্তু না, আসলে এত সহজেই আইনস্টাইনের তত্ত্বটি বোঝা যাবে না। যে সূত্রটি হাজার বছর ধরে প্রচলিত স্থান ও সময়ের ধারণাকে একেবারে আমূল বদলে দিয়েছে তা আসলেই খুব সহজ নয়। আইনস্টাইন বিজ্ঞানীদের আরো জটিলতার মধ্যে ফেললেন, যখন বললেন, একটা নির্দিষ্ট স্থানে আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। কারণ, স্থান আসলে বাঁকা, তখন পদার্থবিজ্ঞান আরো এক ভয়াবহ হুমকির মধ্যে পড়ল। আলো বাঁকবে কেন? স্থান বক্র হবে কেন! তখন পদার্থবিজ্ঞানের এতটা অগ্রগতি ছিল না যা দিয়ে মানুষ বুঝতে পারবেন আসলেই সেই সূদূর মহাবিশ্বে কী হচ্ছে! আইনস্টাইন নিজেই সেই সমস্যা সমাধানের জন্য মাঠে নেমেছিলেন। জীবনের শেষ সময়টা ব্যয় করলেন (Unified Field Theory) বা সমন্বিত ক্ষেত্র তত্ত্ব, ঐক্যবদ্ধ সূত্র আবিষ্কারের পেছনে। তিনি এমন একটি তত্ত্ব গঠন করতে চেয়েছিলেন যা দিয়ে প্রকৃতির সব রহস্যকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর পাশা খেলেন না। দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি এ সমস্যা পেছনে লেগে ছিলেন। কিন্তু, তিনি পারলেন না। ব্যর্থ হয়ে গেলেন। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল যখন তিনি মারা গেলেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার অগোছালো টেবিলটির ছবি ছাপানো হয়েছিল। শিরোনাম ছিল : ‘The unfinished manuscript of the greatest work, of the greatest scientist of our time’। সেই অসমাপ্ত কাজ অবশ্য সমাপ্ত হয়েছে তার দেখানো পথ ধরেই। অনেক পরে জানা গেল আলোর গতি যে বেঁকে যায় তার কারণ মহাবিশ্বে লুকিয়ে আছে অনেক পদার্থ, ডার্ক মেটার, যার পরিমাণ দৃশ্যমান পদার্থের চেয়ে বহুগুণ বেশি, প্রায় ৯৫ শতাংশ। ব্ল্যাকহোলও সেরকম এক পদার্থ। ওই বিপুল ভারী পদার্থের কারণেই মহাবিশ্ব শুধু বেঁকেই যায় না, ওই বাঁকানোর কারণেই সৃষ্টি হয়েছে দুটি মৌলিক বলের।

যাই হোক, সে অন্য আলাপ, পদার্থবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব। আইনস্টাইনই সম্ভবত একমাত্র বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের বাইরে সাধারণ মানুষেরও তার সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ। তার সম্পর্কে প্রচলিত মিথগুলো স্কুলপড়ুয়া ছেলেরাও জানে। স্কুলজীবনে ছিলেন সাধারণ একজন ছাত্র, পাস করার পরও দুই বছর বেকার। বাবা চেয়েছিলেন ছেলেটা যেন মোটামুটি একটা চাকরি জোগাড় করে নিতে পারে। বেখেয়ালী ছেলে ট্রেনে উঠে কোথায় নামবে সেটা ভুলে যায়। স্কুলের হেডমাস্টার পর্যন্ত বলেছিলেন, এ ছেলেকে দিয়ে বেশি কিছু আশা না করাই ভালো। এই ছেলেই একদিন হয়ে উঠলেন মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুষদের একজন। বলা হয়, আইনস্টাইন মানবমস্তিষ্ককে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছিলেন। তার মস্তিষ্কটি এখনো সংগ্রহে আছে গবেষণার কাজে। মৃত্যুর আগেই আইনস্টাইন বলে গিয়েছিলেন, তার মৃতদেহটি যেন পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সমাধিচিহ্ন যেন না রাখা হয়। মৃত্যুর পর কোনোরকম শোকসভা, শোকমিছিল, শেষকৃত্যানুষ্ঠানেরও বিরোধী ছিলেন তিনি। বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পরও নিজেকে নিয়ে মাতামাতি তিনি পছন্দ করতেন না। তাই এখনো তার মৃত্যুর পরও তার জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুদিবস নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলেও কোনোরকম ভক্তিপূর্ণ অনুষ্ঠান পালন করা হয় না, যা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হয়।

জীবনের শেষ একটি বছর তিনি খুব শারীরিক কষ্ট পেয়ে গেছেন। পেটের ভেতর একটা ফোঁড়া হয়েছিল। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল ভোরে প্রচণ্ড পেটব্যথায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দ্রুত তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার জানালেন পেটের ফোঁড়া ফেটে গেছে। আইনস্টাইন বিড়বিড় করে জার্মান ভাষায় কী যেন বলেছিলেন, আমেরিকার প্রিন্সটন হাসপাতালের নার্সরা তা বুঝতে পারলেন না। রক্তক্ষরণে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। সেদিন বিকালেই কোনোরকম শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ছাড়াই তার মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হলো। পোড়া ছাই ভাসিয়ে দেওয়া হলো ডেলাওয়ার নদীতে। তার আগেই হাসপাতালের প্যাথোলজিস্ট ডাক্তার টমাস হার্ভি আইনস্টাইনের মরদেহ অটোপ্সি করার সময় কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই তার ব্রেনটি খুলে রেখে দিয়েছেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এটা কাউকে জানানো হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক মস্তিষ্কটির কিছু অংশ এখন ফিলাডেলফিয়ার মিউটার মেডিকেল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।

আইনস্টাইনকে নিয়ে দু’চার কথায় কিছু লেখা অসম্ভব ব্যাপার। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থ। তার জীবনী প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের প্রায় সমস্ত ভাষায়। তাকে নিয়ে প্রচলিত মিথ-গল্পের কোনো শেষ নেই। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পুরো ভিত্তিটি দাঁড়িয়ে আছে তার তত্ত্বের ওপর। ১৮৭৯ সালের ১৪ এপ্রিল তিনি জন্মেছিলেন জার্মানিতে। ইহুদি বংশের মানুষ হলেও সমস্ত ধর্মকর্মকে একই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা মনে করতেন। তিনি শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন অসামান্য একজন দার্শনিক। মানুষের মুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, কখনো প্রশ্ন করা বন্ধ করো না, প্রশ্নই তোমাকে মুক্তি দেবে। ১৯৫৫ সালের আজকের এই দিনে ৭৬ বছর বয়সে মহাকালের মহিমান্বিত নকশা হাতের মানুষটি মহাকালের পথে পাড়ি জমান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads