• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

শোবিজ

ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম বনলক্ষ্মী

  • প্রকাশিত ০৯ জুলাই ২০১৯

সংস্কৃতিকে কেবল বিনোদন মনে করা উচিত নয়। সংস্কৃতি হচ্ছে দিনবদল, সমাজবদল, রাষ্ট্রবদল ও সরকার বদলের হাতিয়ার। আমরা এটা বারবার প্রমাণ করেছি। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাড়াজাগানিয়া গান এর প্রমাণ। এখনো সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার বদলের জন্য গণসংগীত বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। গান মানুষের প্রাণে আশার সঞ্চার করে। মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করে। এ ছাড়া মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। এ কারণেই আমি সব সময় আমার শিল্পী সত্তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি গণমানুষের জন্য, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। আগামী দিনেও গাইব, সেই আশা রাখি। একান্ত আলাপচারিতায় এ কথা বলেন গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। সঙ্গে ছিলেন রবিউল কমল

এই পথচলা শুরু হলো যেভাবে?

আমার বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গাতে। আমাদের এলাকায় প্রচুর হিন্দু বাস করত। সে কারণে একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছে। আমি বন্ধুদের সঙ্গে গলা ছেড়ে কীর্তন গাইতাম, বাউল গান গাইতাম। বিভিন্ন গানের আসরে যেতাম। বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন। এভাবে গানের প্রতি আমার ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়। এরপর বাবা বাড়ির জন্য একটি রেডিও কিনলাম। তখন রেডিওতে গান শেখার অনুষ্ঠান হতো। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে এ অনুষ্ঠান শুনতাম। সুর মিলিয়ে গান গাইতাম। এভাবেই আমার সংগীতের সঙ্গে পথচলা শুরু হয়।

গণসংগীত কেন বেছে নিলেন?

মাতৃপ্রেম বা দেশপ্রেম-দুটিই আমাকে বেশ টানে। দেশপ্রেম আমাকে সাহস জোগায়। সংগীতের অনেক শাখা থাকার পরও আমি সারা জীবন গণসংগীত করেছি মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা থেকে। আর আমি আজও মানুষের জন্য গান গাই।

আপনি যেভাবে গণসংগীতকে বিশ্লেষণ করেন?

সংগীতের সঙ্গে যখন ‘গণ’ শব্দটি যুক্ত হয়ে এক ভিন্নধর্মী সংগীত ভাষার জন্ম দেয় তখন তাকে আমরা গণসংগীত বলি। গণসংগীত মুক্তির গান, শোষণ মুক্তির গান এবং মানব মুক্তির গান। সংগীত আমাদের বিশ্বস্ত সহচর। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ’৬২, ’৬, ’৬৯-সহ বাঙালির অনেক আন্দোলন সংগ্রামের সাথী এই গণসংগীত।

মোট কতটি ভাষায় গান করেছেন?

বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে আমি সংগীত পরিবেশন করার জন্য গিয়েছি। আমার বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষায় যেমন গান করেছি তেমনি চায়নিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ ভাষাসহ বিশ্বের যখন যে দেশে গিয়েছি, সেই দেশের ভাষায় গান তুলে এরপর আমরা পরিবেশন করেছি। ১৯৭৭ সালে প্রথম কালচারাল ডেলিগেট হিসেবে আফগানিস্তান সফর করি। এরপর বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। অনেক জায়গায় সুযোগ পেয়েছি প্রখ্যাত ওস্তাদদের সঙ্গে গান করার। আমার মনে পড়ে, ১৯৮৯ সালে কোরিয়া সফর করেছিলাম। তখন বর্তমান প্রেসিডেন্টের দাদা ছিলেন ক্ষমতায়।

কোন মাধ্যমে গান করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

আমি আসলে অনেক জায়গায় অনেক মাধ্যমে কাজ করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি মঞ্চে। এখানে একটা মায়া আছে। দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়। প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে।

গানের পরিসংখ্যান-

এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি গান করেছি। ৩০টি অ্যালবাম করেছি। আশির দশকে দেবু চৌধুরীর প্রযোজনায় বৈশাখী প্রোডাকশন থেকে ‘আউল বাউল ফকির’ শিরোনামে আমার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এরপর ডন মিউজিক থেকে সখিনার সিরিজ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ৩টি সখিনা ও চারটি পার্বতীপুর স্টেশনে। কনকর্ড থেকে প্রকাশিত হয় শবমেহের, উরিরচরের সখিনা, মধুমিতা মুভিজ থেকে প্রকাশিত হয় মুক্তি, টোকাই, সরগম থেকে সখিনার বিলাপ, শিখা অনির্বাণ অ্যালবাম। সেখানে জন হেনরি, ম্যান্ডেলার মতো গানগুলো ছিল। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

নিজের গানের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কয়েকটি গানের কথা জানতে চাই-

অমি মনে করি, বাগানের সব ফুলই সুন্দর আমার কাছে আমার সব গানই সন্তানতুল্য। তবে এর মাঝে মায়ের একধার দুধের ধার, ইস্কুল খোলেছেন, মন আমার দেহ ঘড়ি ও সখিনা, মোর সখিনার কপালের টিপ, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কালো কালো মানুষের দেশে, বনমালি তুমিসহ অসংখ্য গান মানুষের মুখে মুখে।

নিজেকে কোন পরিচয় দিতে বেশি ভালো লাগে?

আমি গণসংগীতের শিল্পী হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এরপরও শ্রোতা আমাকে যেভাবে প্রিয় মনে করেন, সেখানে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ শ্রোতা ভালোবাসাই হচ্ছে বড়। আমি যদি চেতনায় লেলিন হই, তাহলে লালন হতে পেরেছি। যদি মার্ক্স হই চেতনায়, তাহলে মাইজভাণ্ডারি হতে পেরেছি।

একাত্তরের স্মৃতিচারণা-

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ষাটের দশকের আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে গণ-অভ্যুত্থান অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার শিবচরে। প্রথমে ১ জুলাই ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য যাই। এরপর যুদ্ধে অংশ নিই। পরে ফিরে আসি। এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যখন অনুষ্ঠান শুনতাম, তখন মনে হতো আমাকে সেখানে গিয়েই গানের মাধ্যমে যুদ্ধ করতে হবে। সেটা আমি করেছি। যশোর রোড ধরে গিয়েছিলাম। মৌসুমী ভৌমিকের যশোর রোডের গানটি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ শুনে তখন আমরা ২১ কিংবা ২২ বছরের এবং আরো কম বয়সের অনেকে তখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এখানে রাজপথে দুরন্ত মিছিলে সবাই ছুটে আসে রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ ভেসে আসে। তিনি যেন কবিতার ঢেউ ঠেলে দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আমি স্যালুট করি জাতীয় চার নেতাকে। আমি স্মরণ করি যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই দিনগুলোর কথা বলুন-

স্বাধীন বাংলা বেতারের গান সরাসরি সম্প্রচার হতো। একটা মাইক্রোফোন দিয়ে তবলা, দোতারা, হারমোনিয়ামে ও মন্দিরার সাউন্ড যেত। সেই সময় কত কষ্ট করে আমরা গান করেছি। আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির গান, স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ও মুক্তির গান—এই তিন পর্বে ভাগ করা যায়।

এখনো যে স্বপ্ন দেখেন-

আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, সেই স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এটা হতে হয়তো আরো সময়ের প্রয়োজন। আজকের বাংলাদেশ এখনো ধূলি, ধূসর, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের জনপদ। এই জনপদ কবে হবে সখিনার দীপ্ত পদভারে সবুজ ফসলের মাঠ। সেদিন স্বপ্ন ছিল শোষণহীন ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু এটা বাস্তবায়িত হয়নি। ভবিষ্যতে হবে সেই প্রত্যাশা করি।

মজার স্মৃতি-

আমার বিয়েটা প্রেমের। আমার ভক্ত ও অনুরাগীদের অনেকেই আমাকে চিঠি লিখতেন। এর মধ্যে তিনিও একজন। তাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম বনলক্ষ্মী। এখন সে আমার ঘরের লক্ষ্মী। আমি, ফিরোজ সাঁই ও আমার আরো দুই বন্ধু মিলে শাহবাগে গভীর রাত পর্যন্ত বনলক্ষ্মীর চিঠির জবাব লিখতাম। চিঠি আসত আবার অন্য এক আপার বাসায়। সেখানে গিয়ে চিঠি নিয়ে আসতাম। কত কষ্ট করে একটি চিঠি হাতে পৌঁছাত, তা কল্পনাও করা যায় না।

গান নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা-

গণসংগীতের সমন্বয় পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংগীত নিয়ে ভবিষ্যৎ হচ্ছে গণসংগীতকে প্রাতিষ্ঠানিভাবে রূপ দেওয়া হবে। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী রয়েছে। গণসংগীত অ্যাকাডেমি করব। আমার বিশ্বাস, এর মধ্য দিয়ে আরো অনেক ফকির আলমগীর বের হয়ে আসবে। আমরা গণসংগীতের তেমন শিল্পী পাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব বিকল্প খুঁজে বের করা। এ জন্যই অ্যাকাডেমি করতে হবে।

অবসরে কীভাবে কাটান?

আমি অবসরে লিখি। এ পর্যন্ত আমার ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। আগামী দিনে আরো কিছু বই বের হবে।

কোনো অপ্রাপ্তি আছে?

আমি ২০১৩ সালে ফেলোশিপ পেয়েছি, ২০১৫ সংগীতে মহাসম্মান পদক পয়েছি পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে, ২০১৮-তে ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড আমেরিকাতে, একুশে পদক পেয়েছি এটি খুব স্মরণীয়। কারণ এবিএম মূসা, সুভাস দত্ত, কেজি মোস্তফা, হাসান আজিজুল হক, হাসান ইমাম, আলি যাকের, আলতামাসসহ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বলদের সঙ্গে পেয়েছি ১৯৯৯ সালে। সেই ১৯ বছর আগে। সেই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা পদক আমার প্রাপ্য ছিল। কারণ আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে বা ৫০ বছর গণসংগীতকে আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছি। সামাজিক দায়বদ্ধতায় যেমন বন্যাসহ জাতীয় দুর্যোগ, মহামারী, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ সমসাময়িক বিষয় ছাড়াও আমি শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে গান গেয়েছি। লেলিন থেকে লালন, মাক্স থেকে মাইজভাণ্ডারি, গানের এই যে তাল এটা ধরে ৫০ বছর থেকে যে অবদান রাখছি সেটির জন্য আমি স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখতে পারি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads