• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
৪৫০টি ছবিতে গান করেছি

ছবি : সংগৃহীত

শোবিজ

৪৫০টি ছবিতে গান করেছি

  • প্রকাশিত ২২ আগস্ট ২০১৯

দেশের সংগীতাঙ্গনে মো. খুরশীদ আলম এক উজ্জ্বল নাম। দীর্ঘদিন ধরে গেয়ে গেছেন দেশের রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে। এখন আর আগের মতো গাইতে পারেন না। তবে গানকেই ধ্যান-জ্ঞান করে বেঁচে আছেন। দীর্ঘ আলাপচারিতায় জীবনের নানান গল্প, স্মৃতির ডালা মেলে ধরলেন সম্প্রতি। মো. খুরশীদ আলমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রবিউল কমল-

 

সংগীতের সঙ্গে যেভাবে পথচলা শুরু-

আমার সেজো চাচা আবু হায়দার সাজেদুর রহমান। তিনি রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ছিলেন। তবে আমার দাদা কিছুতেই চাইতেন না যে ফ্যামিলিতে কেউ গান-বাজনা করুক। দাদার কথা ছিল, তুমি যদি আমার ছেলে হয়ে থাকতে চাও, তাহলে গান-বাজনা কোরো না। সে জন্য তিনি গানকে প্রফেশন হিসেবে নেননি। গান করতেন এবং করাতেন। নাচ করতেন এবং করাতেন। সৈয়দ হাসান ইমাম ভাইয়ের ওয়াইফ লায়লা হাসান তার ছাত্রী। চাচা আমাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কেবল ম্যাট্রিক পাস করেছি তখন। তিনি বলেছিলেন, তিন ডব্লিউ থেকে দূরে থাকবে, ওয়েলথ, ওয়াইন ও ওমেন। কোনো চাচা তার ভাতিজাকে এভাবে বলে কি না আমার জানা নেই। রয় হাউস বলে একটা বাড়িতে একটা গার্লস স্কুল ছিল। প্রতি শুক্রবার চাচা সেখানে গান শেখাতেন। আমিও গান গাইতাম। বিভিন্ন স্কুল থেকে ছেলেরা সেখানে আসত। আবৃত্তি, গল্প, কৌতুক, ভ্রমণকাহিনী বলত তারা। স্কুল ব্রডকাস্টিং অনুষ্ঠান হতো একটা। সে সময় আমি রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম। তখন ঢাকার প্রত্যেক স্কুলে গান, ড্রয়িং ও পিটির জন্য আলাদা শিক্ষক ছিল। উর্দু ও সংস্কৃতি পড়ানোর শিক্ষক ছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে পরপর দুবার শিক্ষাসফরের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হই আমি। আধুনিক গানে প্রথম হই, পল্লীগীতিতে দ্বিতীয়। তখনো বাংলাদেশের কোনো সিনেমার গান জানতাম না। তখন থেকেই শুরু, আর এখনো চলছে।

আপনার অনুপ্রেরণা?

আমার মূল অনুপ্রেরণা বললাম সেজো চাচা ছিল। এরপর যখন ভালো করতে শুরু করলাম, দাদাও মেনে নিলেন। তিনিও অনুপ্রেরণা দিতেন। বাবা-মা পাশে ছিলেন। এছাড়া আমার তখনকার প্রতিবেশীরা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করত।

কোনো প্রতিবন্ধকতা এসেছিল?

আমার সংগীতজীবনের শুরুতেই বিরাট প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় ১৯৬৫ সালে। তখন পর্যন্ত আমি শুধুই রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছি। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান রবীন্দ্রসংগীত ব্যান করলে পড়ে গেলাম বিপদে। না বেতারে গাইতে পারি, না মঞ্চে গাইতে পারি। তবে রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী হতে না পারি, শিল্পী হয়েছি। আমি মনে করি, একজন মানুষ চেষ্টা করলে তার টার্গেটের পুরোটা না পারুক, ৭৫ শতাংশ অর্জন করতে পারে।

প্রথম গাইলেন কবে?

১৯৬৬ সালে বেতারে অডিশন দিই। অডিশন নেন গুণী সুরকার রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ আবদুল আহাদ সাহেব। শান্তিনিকেতন থেকে পাস করা। ছিলেন সমর দাস আর ফেরদৌসী আপা। গান শোনার পর সমর দাস বললেন, গলা খুব ভালো; কিন্তু তুমি একজনকে নকল করো। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ওই শিল্পী যত দিন আছে, তোমার গান কেউ শুনবে না। সবাই বলবে, খুরশিদ আলম গান গায় অমুক শিল্পীর মতো। সমর দাস বললেন, কোথায় থাকো? বললাম কাজী আলাউদ্দিন রোড। তিনি লক্ষ্মীবাজার থাকতেন। প্রতিদিন সকাল সাতটায় তার বাসায় যেতে বললেন। বললেন, হাফ অ্যান আওয়ার আমি তোমাকে শেখাব। তিনি পিয়ানোতে ‘সা’ ধরে থাকতেন। গান শেখাতেন না, সা রে গা মা পা ধা নি সা শেখাতেন। একদিন বললেন, যা, দশটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে গাবি। সবার থেকে তোর গলা আলাদা। সমরদা ইজ নট মাই রিলেটিভ। দেওয়া-নেওয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কোনো টাকা নিতেন না। ওনার বাবা বলতেন, ছেলেটাকে মেরে ফেলবে? তিনি বলতেন, মানুষ করছি। এরপর প্রথম গান করলাম ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ বেতারে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আমার দুটি গান আজাদ রহমান করেছিলেন। একটির গীতিকার কবি সিরাজুল ইসলাম। সুরকার আজাদ রহমান, ‘তোমার হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম/ থাকব তোমারই আমি কথা দিলাম।’ আরেকটি জেবুন্নেসা জামান লেখেন, সুর করেন আজাদ রহমান, ‘চঞ্চল দুনয়নে বলো না কি খুঁজছ/ চম্পা-না করবী-না পলাশের গুচ্ছ’। প্রথম গানটি অল ওভার পাকিস্তান ডিস্ক সেল হতো।

আপনার টার্নিং পয়েন্ট ছিল কোনটা?

আমি যখন সিনেমার গানে অফার পেলাম তখন আমাকে কেউ শিল্পী হিসেবে মানতেই পারছিল না। আজাদ রহমান বেঁকে বসলেন। ওই ছবির হিরো ছিলেন রাজ্জাক সাহেব। তিনি আমাকে বললেন, কাম টু মাই হাউস। তার বাসায় গিয়ে শিখলাম- রাজ্জাক সাহেব কীভাবে রাগে, কথা বলার ঢংটা কেমন, হাসলে কীভাবে হাসেন, রোমান্টিক হলে কীভাবে কথা বলেন। তারপর বললেন, আমি তোমার গানে লিপসিং করব। এটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।

এখন পর্যন্ত কতগুলো গান করেছেন?

এখন পর্যন্ত ৪৫০টি ছবিতে গান করেছি। আমার গানে সবচেয়ে বেশি লিপ রাজ্জাক, ওয়াসিম, মাহমুদ কলি, আলমগীর সাহেব, জাভেদ সাহেব। ডুয়েট গেয়েছি কনকচাঁপা, বেবি নাজনীন, রিজিয়া পারভীন, রুনা, সাবিনা, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, জুলিয়া রহমান, মৌসুমী কবির, শাম্মী আখতার, শাকিলা জাফর এদের সঙ্গে।

নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ-

এখনকার প্রজন্ম অনেক মেধাবী, অত্যন্ত ফাস্ট। প্রচুর জানে, অনেক কিছু তাড়াতাড়ি ক্যাচ করতে পারে। তবে তাদের কোনো অভিভাবক নেই। আমরা যখন গাইতাম, ১০-১২ জন লোক সামনে বসা থাকত। তারা বলতেন, তাল কেটেছে, উচ্চারণ ঠিক হয়নি, উল্টো গেয়েছ। এখন এসব নেই। এখন সবাই গীতিকার, সবাই কম্পোজার। আমি কাউকে ছোট করছি না, কিন্তু একজনকে সবকিছু কেন করতে হবে? গান-বাজনা চর্চার ব্যাপার, গুরুমুখী বিদ্যা। যে যত শিখবে, সে তত টিকবে। যে যত শিখবে, সে তত জিতবে। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। এখন কেউ না শিখে এই জগতে এলে সে ফাঁকিতে পড়বে। গান-বাজনা একটা পবিত্র জিনিস। যার যার জায়গায় সিনসিয়ারলি কাজ করলে পারবে। অভিভাবক থাকতে হবে। আমার থেকে কেউ বেশি বোঝে না এমন মানসিকতা ছাড়তে হবে।

গান নিয়ে একটা মজার স্মৃতি বলুন-

একবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। আমার তো গাড়ি ছিল না, তাই বেশিরভাগ সময় হেঁটে চলাফেরা করতাম। ছিনতাইকারী কোমরে অস্ত্র দেখিয়ে বলেছিলেন, আপনাকে এখানে মেরে রেখে গেলে একটা গাড়িও থেমে দেখতে আসবে না। আপনার একটা গান আমার অনেক ভালো লাগে। দুই লাইন গেয়ে শোনাবেন? আমি ছিনতাইকারীকে গান শুনিয়েছিলাম। পরে সেই ছিনতাইকারী আমাকে কিছু পথ এগিয়ে দিয়েছিল। এই স্মৃতির কথাটা আমি প্রায়ই বলি।  কারণ এই ঘটনা আমার এখনো মনে পড়ে।

অবসরে কী করেন?

অবসরে গান-বাজনা করি, টেলিভিশনে খবর দেখি আর ক্রিকেট খেলা দেখি।

কোনো অপ্রাপ্তি আছে?

আসলে আমি একক প্রচেষ্টায় খুরশিদ আলম হইনি। আমার শিক্ষকরা, গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী, টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী, দর্শক সবাই মিলেই আমাকে তৈরি করেছে। টাকা-পয়সা নেই, বাড়ি-গাড়ি নেই তাতে আফসোস নেই। তিন বেলা খেতে পারছি, এতেই আমি খুশি। শিল্পী হতে চেয়েছিলাম, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হতে পারলাম না, কিন্তু আধুনিক গানের শিল্পী হয়েছি। এতেই আমি খুশি। আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads