• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
‘রবীন্দ্রসংগীত স্বরলিপিনির্ভর, এর সুর কখনো বিকৃত হয়নি’

ছবি : সংগ‍ৃহীত

শোবিজ

‘রবীন্দ্রসংগীত স্বরলিপিনির্ভর, এর সুর কখনো বিকৃত হয়নি’

  • বিনোদন প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

এদেশের বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদী মহম্মদ। করোনার জন্য ঘরবন্দি থেকে বেশ কিছু সংগীতায়োজনে অংশ নিয়েছেন তিনি। দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের মনে সাহস জোগাতে তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়েছেন সম্মিলিত গান।

রবীন্দ্রসংগীতের বাইরে এবার আধুনিক গান গাইলেন এ শিল্পী। ‘চলো একসাথে দূরে থাকি’ গানটি সম্পর্কে সাদী মহম্মদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে গানটি তৈরি করা হয়েছে। গানের মাধ্যমে আমরা বলছি দূরে থাকার কথা। এই দূরত্ব মনের নয়, বরং করোনা মহামারীর হাত থেকে নিরাপদে থাকতে এই আহ্বান। যেকোনো দুর্যোগের সময় একজন মানুষ আরেকজন মানুষের পাশে থাকবে, লড়াই করার শক্তি ও সাহস জোগাবে-এটাই স্বাভাবিক। আমরাও এই গান গেয়েছি মানুষের মনে সাহস জোগাতে। তাই এটি রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক নাকি পপরক বা অন্য কোনো ঘরানার গান, তা নিয়ে আলাদা করে ভাবিনি। তা ছাড়া রবীন্দ্রসংগীত গাই বলে অন্য কোনো ঘরানার গান গাওয়া যাবে না এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। আরেকটি বিষয় হলো, এই গানের জন্য শারমিন সুলতানা সুমির সুর, গাউসুল আলম শাওনের গীতিকথা আর পাভেল অরিনের সংগীতায়োজন যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনই ভিন্ন ধাঁচের।’

চৈত্রসংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, ঈদ থেকে শুরু করে বাইশে শ্রাবণসহ বেশ কয়েকটি দিবস ও উৎসব পেরিয়ে গেল। কিন্তু করোনার কারণে সবই স্থবির। এই যে স্থবিরতা বিষয়ে সাদী মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা কেউ কি জানতাম, কখনো এমন দুর্যোগের মুখোমুখি হবো। কোনো কিছুর জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। জীবনের চেয়ে দিবস বা উৎসব বড় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। উৎসব, আয়োজন সবকিছুর মূলে থাকে জীবনকে সাজানো, নানাভাবে রাঙানো এবং আনন্দময় করে তোলা। তাই পহেলা বৈশাখ, ঈদ, রবীন্দ্রজয়ন্তীসহ অন্যান্য আয়োজন ফিকে হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো আফসোস নেই। আমরা যদি ভালো থাকি, তাহলে আগামী সময়টা নানা উদযাপনের মধ্য দিয়ে পার করতে পারব।’

তৎকালীন সময়ে খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারে রবীন্দ্র সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সাদী মহম্মদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫২ সালে। অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবার হবার কারণে সাদী মহম্মদ খুব ছেলেবেলা থেকেই নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, রোজা পালনের মাধ্যমেই বেড়ে ওঠেন। বাড়িতে সে সময় টেলিভিশন ছিল না, হারমোনিয়াম ছিল না গান-বাজনার তো প্রশ্নই ওঠে না; তবে ঘরে সে সময় মর্ফি রেডিও ছিল সেটাতে ইস্ট পাকিস্তান রেডিওতে হেমন্ত, প্রতিভা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোহরাব হোসেনের গান হতো। সেই গান শুনে শুনে গান শেখা শুরু হয়। সাদী মহম্মদের বাড়িতে রেওয়াজ বা গান চর্চা প্রবণতা তখনো গড়ে ওঠেনি। সাদীর বড় বোনও ভালো গান করতেন, তবে খালি গলায়। স্কুলে থাকাকালীন তিনি গানে তেমন সাফল্য দেখাতে পারেননি, স্কুলের কোনো প্রোগ্রামেও তিনি গান করার সুযোগ পেতেন না। ১৯৭১-এ স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে ভর্তি হলেন। তখন কলেজের বিভিন্ন প্রোগ্রামে গান করতেন সাদী। ভালো গান করার জন্য তার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকেই। বরাবরই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তার আদর্শ ছিল। সাদী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং বরাবরই খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। খুব বেশি তাকে পড়তে হতো না, একটুু পড়লেই হয়ে যেত।

হেমন্ত ছিল সাদী মহম্মদের একমাত্র আদর্শ। একদিন আগরতলা রেডিওতে শুনলেন হেমন্তের কণ্ঠে ‘এই কথাটি মনে রেখো’-এ গানটি শুনে তিনি রবীন্দ্র সংগীতের প্রেমে পড়ে যান। রবীন্দ্র সংগীত যে এত মুক্ত খোলা গলায় করা যায় সেটা আগে বুঝতে পারতেন না হেমন্তের গলায় শোনার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনিও রবীন্দ্র সংগীত শিখবেন। তারপর রবীন্দ্র সংগীতের যা যা রেকর্ড বের হতো তিনি সংগ্রহ করতেন। তার বড় দাদা বিমানে চাকরি করতেন তিনিই সাদীকে এগুলো সংগ্রহ করে এনে দিতেন।

মা-বাবার ইচ্ছা ছিল সাদী মহম্মদ ইঞ্জিনিয়ার হবে। সাদী মহম্মদ ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। সাদী দ্বিতীয় বর্ষে উঠে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রতি তিনি কোনো আগ্রহই পাননি। গান ভালোবাসতেন বলে গানটাই তাকে টানত ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তি নিকেতনে চলে যান সংগীত বিষয়ে পড়াশোনা করতে। তার মা সে সময় বলেছিল ওকে বোলপুরে পাঠিও না, ওকে হেমায়েতপুরে পাঠিয়ে দাও। পরিবারের সবারই অমত ছিল সংগীত নিয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে।

সাদী ১৯৮০ সালে দেশে ফেরেন স্বৈরাচার সরকারের সময়ে। দেশে এসে তিনি একটু হতাশ হয়েছিলেন কোনো চাকরি নেই, টিউশনি নেই হঠাৎ করে তিনি অবশ্য সরকারি সংগীত কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যান ১৯৮২ সালে তারপর বাড়িতে প্রচুর ছাত্রছাত্রী গান শিখতে আসত। এভাবেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। রবীন্দ্র সংগীতের ক্ষেত্রে তার ছিল একক আধিপত্য। আজ অবধি কেউ তার সমকক্ষ হতে পারেননি। রেডিও টেলিভিশনসহ দেশে-বিদেশে তিনি প্রচুর অনুষ্ঠান করেছেন। জার্মানি, ফ্রান্স, ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কানাডা, নর্থ আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনি গান পরিবেশন করেছেন। সাদীর হাতে গড়া বহু ছাত্রছাত্রী রয়েছেন, যারা আজ প্রতিষ্ঠিত। অদিতি মহসিন, নন্দিতা ইয়াসমীন, সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, ইন্দ্রানী কর্মকার, স্বপন দত্ত, গোলাম হায়দার, শামা রহমান, আমিনা আহমেদ প্রমুখ। তার বহু ছাত্রছাত্রী দেশের বাইরে রয়েছে।

শান্তি নিকেতনের দিনগুলো গান নিয়ে পড়ালেখার মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা পালন করে পার করেছেন। কাজের মধ্যেই আনন্দ পেতেন ভীষণ উৎসবমুখরভাবে শান্তি নিকেতনে পড়ালেখার বর্ষগুলো কাটিয়েছেন।

সাদী মহম্মদ সরকারি সংগীত কলেজ থেকে ২০১৩ সালে অবসর নেন। যদিও অনেক দূরের তার চাকরির বয়স ছিল। তার এ যাবৎ রবীন্দ্র সংগীত ও আধুনিক-সব মিলে ৬৫টি সিডি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি গান গাওয়ার পাশাপাশি সংগীত পরিচালনাও করেন। ১৯৯৪ সালে তার গুরু কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে এলে তার পরিচালনায় গুরুকে দিয়ে ৫টি গান রেকর্ড করান যা শুনে কনিকা ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে এ শিল্পী বলেন, ‘মানুষের মনের গহিনে যে কথা লুকিয়ে থাকে, তা অনায়াসে নিজের সৃষ্টিকর্মের মধ্যে তুলে ধরতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ কারণেই তার গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গানসহ প্রতিটি সৃষ্টি শত বছর পরও সমকালীন বলে মনে হয়। যে জন্য শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তার সৃষ্টি সমান আদরের।’

বিশ্ব সংগীতের আগ্রাসনে নতুন প্রজন্ম নানা ধরনের সংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এমন সময়ে কবিগুরুর গান তরুণ প্রজন্মের কাছে আদৌ প্রভাব ফেলতে পারবে কি না। এমন সংশয়ে চিন্তিত নন তিনি। বলেন, ‘প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গেয়ে যাবে কবিগুরুর গান, এই আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। ভিনদেশি সংগীতের আগ্রাসনেও রবীন্দ্র সংগীতের আবেদন ম্লান হতে পারে না। কারণ, কবিগুরুর গানের কথা ও সুর শুধু অনবদ্যই নয়, এক ধরনের সম্মোহনী শক্তির মতো। সহজ কথা, মোলায়েম সুরের মাঝে আছে সূক্ষ্ম জীবনবোধ। তার চেয়ে বড় বিষয় রবীন্দ্রসংগীত স্বরলিপিনির্ভর, যে জন্য এর সুর কখনো বিকৃত হয়নি।’

সাদী গানের মধ্য দিয়ে অনেকের অনেক ভালবাসা পেয়েছেন, শ্রদ্ধা পেয়েছে, পৃথিবীজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads