• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
গরম ও যানজটে নগরবাসীর হাঁসফাঁস

ছবি : সংগৃহীত

আবহাওয়া

গরম ও যানজটে নগরবাসীর হাঁসফাঁস

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ মে ২০১৯

ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাব দূর হতেই গরম শুরু। এখন তা রীতিমতো দাবদাহে পরিণত হতে চলেছে। ভ্যাপসা গরমে কাহিল নগরবাসী। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় হাঁসফাঁস করছেন তারা।

এর মাঝেই রোজার শুরুতেই যানজট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে মেট্রোরেলের কারণে রাস্তা সরু হওয়ার দুর্ভোগ। তীব্র গরম ও যানজটে নাকাল নগরবাসী বৃষ্টির জন্য তীর্থের কাক হয়ে অপেক্ষা করছেন। কিছুটা আশা জাগিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। তারা বলছে, আজ রোববার বিকাল থেকে বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া সোমবার বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি বৃদ্ধি পেতে পারে। সেই সঙ্গে তাপমাত্রাও অনেকটা কমে যাবে। 

রাজধানীর কয়েকটি ব্যস্ত স্থান ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় থেমে থেমে চলছে গাড়ি। একটার সঙ্গে আরেকটা গাড়ি প্রায় লাগানো। স্বাভাবিক সময়ে যে স্থানে বাসে যেতে ২০ মিনিট লাগে গতকাল শনিবার দুপুরে ওই রাস্তাটুকু পার হতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। তার সঙ্গে রয়েছে অসহনীয় গরম। রোজার মাঝামাঝি থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত রাজধানীবাসীর অনেকটা সময় রাস্তায় কাটে। এ বছর রোজার শুরু থেকেই এই ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী।

যানজটে নাকাল নগরবাসী : রুহুল আমিন শনিবার মিরপুর থেকে বেলা ১১টায় রওনা দিয়ে ফার্মগেট পৌঁছান বেলা ১টায়। তিনি বলেন, পুরো পথেই রাস্তার দুপাশে যানবাহন থেমে থেমে চলছে। ঈদের কেনাকাটা অনেকেই রোজার শুরুতেই সেরে ফেলতে চান। তাই বলে এই অবস্থা হবে কে ভেবেছিল?

তারান্নুম কবির থাকেন কলাবাগান। বাসা থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে ৪০ মিনিটেও পান্থপথে উঠতে পারেননি। তিনি বলেন, মেইন রাস্তার এত বাজে অবস্থা যে আমি গলির মুখ থেকেই বের হতে পারলাম না। তাকিয়ে তাকিয়ে বাইরে হেঁটে যাওয়া খেটে খাওয়া মানুষদের দেখছিলাম আর ভাবছিলাম রোজা রেখে কী ভয়াবহ কষ্টে পড়েছেন। তার সঙ্গে ছিলেন বন্ধু শারমিন সুলতানা। তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় এত গাড়ি, এগুলো চলাচল করতে পারছে না। গতি পাবে কোথা থেকে। আমি প্রতিদিন ওয়ারী থেকে বের হয়ে বসুন্ধরা সিটিতে আসি। কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ট্রাফিকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার মোটামুটি দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে আসতে। বেশিরভাগ সময় গুলিস্তান, পল্টন ও শাহবাগ এলাকায় যানজটে আটকা পড়ে মানুষ। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে কী পরিস্থিতি হবে কে জানে।

রিকশাচালক ফারুক মিয়া মোহাম্মদপুর থেকে রিকশা নিয়ে বের হন সকাল ৭টার ভেতর। প্রতিদিন কমপক্ষে ১২টি গন্তব্যে যেতে হয়, না হলে পোষায় না তার। তিনি বলেন, এখন ৭টার বেশি পারা যায় না। জ্যামে বসে থাকি, অনেক সময় যাত্রী বিরক্ত হয়ে অর্ধেক টাকা দিয়ে চলে যায়।

শিশুর ত্রাহি অবস্থা, বাড়ছে রোগ : ভ্যাপসা গরমে কাহিল সবাই। শিশুদের ত্রাহি অবস্থা। বাড়ছে রোগ-বালাই। এরই প্রভাব পড়েছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে। বিশেষায়িত হাসপাতালে পানিবাহিত শিশু রোগী বিগত কয়েক দিনে কয়েক গুণ বেড়েছে। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

সরেজমিনে রাজধানীর বিশেষায়িত ঢাকা শিশু হাসপাতালে গেলে, সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই সপ্তাহ আগেও এই হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ শিশু ভর্তি হতো। এখন বেড়ে হয়েছে ৩০০ থেকে ৫০০। আর আউটডোরে যেখানে গড়ে প্রতিদিন ৬০০ রোগী চিকিৎসা নিত, সেখানে এখন প্রতিদিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

এই হাসপাতালে ছয় মাস বয়সী ছেলের চিকিৎসার জন্য কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে এসেছেন লুৎফা বেগম। তিনি বলেন, হঠাৎ করেই ছেলে তাওহীদ হাসানের পাতলা পায়খানা। দিনে ২০ বারেরও বেশি পায়খানা। তিন দিন ভর্তি। এখন দিনে দু-তিনবার হচ্ছে।

সাত মাস বয়সী ছেলে রবিউল আহসানকে নিয়ে এসেছেন আতাউর রহমান। নরসিংদী থেকে আসা এই বাবা জানান, তার ছেলে ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত। ৫ দিনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

হঠাৎ শিশুরোগী বাড়ার বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাকছুদুর রহমান বলেন, গ্রীষ্মকালে রোগবালাই এমনিতেই বেশি হয়। সারা দেশের মতো এখানেও প্রায় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভ্যাপসা গরম। এতেই কাহিল হয়ে পড়ছে শিশুরা। দু-একদিনের মধ্যে তাপমাত্রা স্বাভাবিক না হলে হাসপাতালে রোগী আরো বাড়বে। তিনি জানান, গরমে শিশুদের ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশি, ব্রংকাইটিস ও নিউমোনিয়া রোগ বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে পানিবাহিত ডায়রিয়া, টাইফয়েডও রয়েছে।

বাড়তি ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে একই হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ছাইফুল ইসলাম বলেন, পানিবাহিত রোগী বাড়ায় চিকিৎসক বাড়ানো হয়েছে। প্রত্যেকেই বাড়তি সময় দিচ্ছেন। পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এসব রোগের মূলে প্রচণ্ড গরম। গরমে শিশুদের ডিহাইড্রেশন তৈরি হয়। এজন্য প্রচুর পানি পান করাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে পানি যেন বিশুদ্ধ হয়। বাসায় তৈরি শরবত ছাড়াও ডাবের পানি খাওয়াতে হবে। খাওয়ার আগে শিশুদের সাবান অথবা হ্যান্ডওয়াসে অভ্যস্ত করতে হবে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক রেজওয়ানুল আহসান বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সিজনাল ফ্লু এবং ভাইরাল ফ্লু বেড়ে গেছে। প্রচণ্ড গরম আর ধূলাবালিতে শিশুদের ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি হচ্ছে। এ কারণে ঠান্ডা-কাশি, শ্বাসকষ্ট, চিকেন পক্স ও চর্মরোগ হচ্ছে।

বিদেশি সংস্থাগুলোর অর্থায়নে পরিচালিত মহাখালীর বিশেষায়িত হাসপাতাল আইসিডিডিআর,বি। এখানে গেল ৫ দিন ধরে ১১ মাস বয়সী ছেলের চিকিৎসা করাচ্ছেন শাহিনা খাতুন। তিনি জানান, ছেলের অবস্থা অনেক ভালো। আল্লাহ চাহেতো, রোববার বাড়ি যেতে পারব।

আইসিডিডিআরবি,র ডা. শারমিন জামান উর্মি বলেন, বিগত কয়েক দিন তাপমাত্রা ব্যাপকহারে ওঠানামা করছে। প্রচণ্ড গরমে মানুষ হাতের কাছে সস্তায় শরবত পান করছেন। রোজায় ভাজা-পোড়া খাচ্ছেন। এতে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের এখানে গড়ে প্রতিদিন ৬০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে। এদের অর্ধেকই শিশু। শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এজন্য তারা ডিহাইড্রেশনের শিকার হচ্ছে বেশি।

উপস্থিতি কমছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে : তাপদাহে রাজধানীর একাধিক স্কুলে কয়েক শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। টানা গরমে ক্লাস ও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েই অচেতন হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। গত তিন দিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলে শিক্ষার্থীর অসুস্থতার খবর পাওয়া গেছে। কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। এ ঘটনার পর পরই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) গত বৃহস্পতিবার রাতে তাদের অধীন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় নতুন নির্দেশনা জারি করে। এতে বলা হয়, স্থানীয় পর্যায়ে তাপ প্রবাহের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি বিদ্যালয়ের নির্ধারিত শ্রেণি কার্যক্রমের সময়সূচি পুনর্বিন্যাস করতে পারেন। এর অংশ হিসেবে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে মর্নিং স্কুল চালু করা যাবে। আর যেসব স্কুলে দুই শিফটে ক্লাস হয়, সেখানে ক্ষেত্র বিশেষে প্রাত্যহিক সমাবেশ স্থগিত করে নির্ধারিত সময়ের আগেই শ্রেণির কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।

তীব্র গরমে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিয়েছে মাউশি।

আজ বৃষ্টির সম্ভাবনা : তীব্র দাবদাহ কেটে আজ রোববার বিকাল থেকে বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ ছাড়া সোমবার বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি বৃদ্ধি পেতে পারে। গতকাল সকালে ঢাকার আগারগাঁওয়ের আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, নোয়াখালী ও দিনাজপুর অঞ্চলসহ ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

গতকাল সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, টাঙ্গাইল অঞ্চলসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।

তাপমাত্রা পরিস্থিতি নিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। তবে অন্যত্র তা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

পূর্বাভাসে বলা হয়, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads