• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
শীতে জবুথবু মানুষ, স্থবির জনপদ

সংগৃহীত ছবি

আবহাওয়া

শীতে জবুথবু মানুষ, স্থবির জনপদ

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২২ ডিসেম্বর ২০১৯

গত কয়েকদিন ধরে চলা শৈত্যপ্রবাহ আক্ষরিক অর্থে কেটে গেলেও কনকনে শীতের দাপট চলছে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিস্তীর্ণ জনপদে। শীতে অনেকটা কাবু হয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকার জনজীবন। রাজধানীও বাদ পড়েনি। গতকাল শনিবারও সূর্যের দেখা মেলেনি নগরে। যেমনটা হয়েছে দেশের একাধিক জেলায়ও।

এদিকে ঘন কুয়াশায় বিঘ্নিত হয় নৌ ও বিমান চলাচল। হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে রোগীর ভিড়ও বাড়ে।

এসবের মাঝেই আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশের দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে; দিনের তাপমাত্রা বাড়তে পারে সামান্য।  অধিদপ্তর এ মাসের শেষের দিকে আরেকটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথাও জানায়।

গতকাল শনিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ফরিদপুরে; ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

তবে ঢাকায় আগের দিনের তুলনায় শীত বেড়েছে। শুক্রবার যেখানে দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শনিবার সকালে তা নেমে এসেছে ১২.২ ডিগ্রি সেলিসিয়াসে।

সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, পৌষের এ সময়ে হিমালয়ের কোলঘেঁষা উত্তর জনপদের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহে ছিন্নমূল আর ভাসমান মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।

ঘন কুয়াশায় ফেরি পারাপারেও বিঘ্ন ঘটে গতকাল সকালে। ঢেকে থাকায় পদ্মার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ৫ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। ঢাকার শাহজালাল ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও কুয়াশার কারণে চার ঘণ্টা বিমান ওঠানামা বন্ধ থাকে।

এদিকে শীতের প্রকোপে রোগ-বালাই বাড়ছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে তিন দিনে প্রায় ছয় হাজার ডায়রিয়ার রোগী চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, আমাশয়, চোখের প্রদাহ ও চর্মরোগেও ভুগছেন অনেকে।

অন্যদিকে শীত সুরক্ষার রক্ষাকবচ হিসেবে সবাই ছুটছেন গরম কাপড় কিনতে। দোকানিরাও হরেক রকমের শীতের পোশাকের পসরা সাজিয়েছেন। গরম কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরগরম রাজধানীর ফুটপাত ও বস্ত্র বিতানগুলো। জেলা শহরগুলোও বাদ যায়নি। সর্বত্র শীতের পোশাক কেনার হিড়িক। বিশেষ করে কম্বল, জ্যাকেট, সোয়েটার, কার্ডিগান, শাল, হাতমোজা ও কানটুপির চাহিদা বিক্রির শীর্ষে। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় খুশি দোকানিরাও।

শীতে দেশের নানা সড়কে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকছে। ফলে হাইওয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স কিছু সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, বর্তমানে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা অনেকাংশে কমে আসছে। এর কারণে সামনের পথচারী ও বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।

এ অবস্থায় বাসস্ট্যান্ডে অবস্থানরত ও মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহনের চালকদের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় ফগলাইট ব্যবহার ও গতিসীমা সীমিত রেখে বেশি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

শীতের তীব্রতা থেকে বাদ যাচ্ছে না দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গবাধিপশুরাও। তাদের সুরক্ষায় প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন গৃহস্থরা। তাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার খবরও মিলছে।

অন্যদিকে আগামী ৫ দিনের পূর্বাভাসে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হালকা বৃষ্টি বা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। চলতি মাসের শেষদিকে তাপমাত্রা আবারো কমতে পারে। জানুয়ারির প্রথমদিকে আরেকটি মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।

রংপুর নগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়ের পান দোকানদার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সকাল বেলা ঠাণ্ডার কারণে দোকানেই আসা যায় না। আবার ঠাণ্ডার কারণে সন্ধ্যার পর দোকানে বসে থাকা যায় না। কখনো দোকোনে ছুটে এলেও বিকাল হতে না হতে কাস্টমার শূন্য হয়ে যায়।

আলমনগর এলাকার আজিমা বেগম বলেন, এই শীতে আর জীবন বাঁচে না। এখন পর্যন্ত একখানা গরম কম্বল পাই নাই।

ফরিদপুরের হাবিব, আওয়াল শেখ, ছরোয়ার হোসেন বলেন, শীতের কারণে কয়েকদিন হলো কাজ নেই। একরকম বসেই দিন পার করছি। এভাবে আরো কয়েক দিন চললে অর্থ কষ্টে থাকতে হবে।

চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দা উম্মে রোমানা বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড শীত। শীতের সঙ্গে বাতাস, বাসার বাইরেই বের হতে পারছি না। কুয়াশায় চারদিক অনেকটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে। বাসার বয়স্করা আর শিশুরা অসুস্থ পড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘আজ ঠান্ডা আরো বেশি পড়েছে। বাধ্য না হলে বাসার কেউ বাইরে বের হচ্ছে না।’

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বাধ্য হয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে সিএনজিতে করে অফিসে গিয়েছিলাম। এখন ঠান্ডা লেগে গেছে, জ্বর জ্বর ভাব। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে শুক্রবার আর বের হইনি। আলমারি থেকে লেপতোশক বের করে ব্যবহার করতে শুরু করেছি।’

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ‌্যাভিনিউ এলাকায় হকার রুমি বলেন, পৌষের শুরুতে টুকটাক বেচা-বিক্রি থাকলেও মঙ্গলবার থেকে ক্রেতার চাপ বেড়ে গেছে। হঠাৎ তীব্র শীতে বেড়ে গেছে গরম কাপড়ের চাহিদা। পাইকারি মার্কেটে দাম বেশি তাই আমরা কম দামে বেশি বিক্রি করতে পারছি না। অন্য সময়ে যে জ্যাকেটের দাম একশ টাকা, এখন তা তিনশ টাকা হাঁকাচ্ছি। তবে দুইশ টাকা হলে ছেড়ে দিচ্ছি। ক্রেতারাও কম কথা বলে কিনে নিচ্ছেন পছন্দেও জিনিসটি।’

গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের নিচে কাজলা থেকে আসা দুই সন্তানের জননী নাজমা বেগম অবশ্য আক্ষেপ করেন বিক্রি নিয়ে, ‘দুইশ টাকার জিনিস এখন ৪০০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। দুই ছেলের জন্য জ্যাকেট ও নিজের জন্য সোয়েটার কিনেছি।’

হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী ডা. আয়শা আক্তার বলেন, ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বাড়ছে। তাদের মধ্যে শিশু আর বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি।

আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা কম থাকলে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে ধরা হয়। সেই হিসেবে গত কয়েকদিন ধরে চলা শৈত্যপ্রবাহ এখন আর নেই। তবে উত্তর-পশ্চিম শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ (জেড বায়ু) বেশি সক্রিয় থাকায় এবং কুয়াশা ও জলীয় বাষ্পে আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। তিনি বলেন, এরকম আবহাওয়া পৌষ মাসে খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও শীতের তীব্রতা আরো দুয়েকদিন থাকবে। তবে এই মাসের শেষের দিকে আরেকটি মৃদু বা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে বলে জানান তিনি।

দৈনিক বাংলাদেশের খবরের প্রতিনিধিরাও শীতের প্রকোপে জনজীবন বিপর্যস্তের কথা জানান—

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হঠাৎ করে তীব্র শীত ও কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধায় শীতের তীব্রতা ও ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে চারদিক। দিনাজপুরের হিলিতে ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। যশোরে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অচল হয়ে পড়েছে জনজীবন। মাগুরায় জেঁকে বসেছে শীত। তীব্র শীতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। মেহেরপুরে কনকনে ঠান্ডায় দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত, ছিন্নমূল মানুষ। নওগাঁর ধামইরহাটে প্রচণ্ড শীতে বৃদ্ধ ও শিশুরা বিপাকে পড়েছে। জয়পুরহাটে বিনা প্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। নীলফামারীতে গত ৪ দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads