• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সঙ্কটে শ্রমবাজার : বাড়ছে প্রবাসী শ্রমিকের দেশে ফেরা

সংগৃহীত ছবি

প্রবাস

সঙ্কটে শ্রমবাজার : বাড়ছে প্রবাসী শ্রমিকের দেশে ফেরা

  • আহমদ আতিক
  • প্রকাশিত ৩১ অক্টোবর ২০১৮

জনশক্তি রফতানিতে নানামুখী টানাপড়েনে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ফিরে আসছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। সৌদি আরব ও লিবিয়া থেকে শ্রমিকরা ফিরছেন নিয়মিত। সৌদি থেকে ফেরা শ্রমিকরা বলছেন, কাজের বৈধ অনুমতিপত্র (আকামা) থাকা সত্ত্বেও দেশটির সরকার তাদের ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। শ্রমিকরা আরো বলছেন, সেখানে অবস্থানকারীদের ভবিষ্যতে ঠিকমতো বেতন পাওয়া নিয়েও সংশয় আছে।

শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাব মতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৯ হাজার ৩৭০ জন (নারী ও পুরুষ) শ্রমিক ফেরত এসেছেন। ২০১৬ সালে ৪১ হাজার ৬২৬ জন এবং গত বছর ৫০ হাজার ১৪৮ জন বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসেন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশেও জনশক্তি রফতানি বাড়ার কোনো খবর নেই।
মালয়েশিয়া থেকেও ফিরে আসছেন শ্রমিকরা নানা কারণে। পাঠানোর বৈধতা ঠিক না থাকায় মালয়েশিয়ায় এ অবস্থা। জঙ্গি তকমায় সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রফতানির বাজার প্রায় হাতছাড়া। এ সুযোগে সেখানে ঢুকছে মিয়ানমার, ভিয়েতনামসহ অন্য এশীয় দেশ।

জনশক্তি রফতানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সংঘাতের প্রভাবে প্রবাসী এসব শ্রমিক ফিরছেন।

বিমানবন্দরে দায়িত্বরত জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান আনসারী জানান, সৌদি আরব থেকে ফেরা পুরুষ শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন, তাদের ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছি, জেলা জনশক্তি অফিসের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিতে।

সৌদি সরকারের তথ্যানুযায়ী ভিশন ২০৩০ অনুসারে সৌদি নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে দেশটির সরকার। তাই গত ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (১ মহররম ১৪৪০) থেকে শুরু করে ৩ ধাপে ১২ রকম কর্মসংস্থানের সব ক’টিকে পুরোপুরি বিদেশিমুক্ত করা হবে। এই ১২ ধাপের মধ্যে পড়েছে বহু বাংলাদেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান। এর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা কত তা জানা সম্ভব হয়নি। ব্যাংক অব সৌদি ফ্রান্সির এক সমীক্ষায় জানা যায়, ২০২০ সালের মধ্যে নিজ দেশে ফিরে যাবে বাংলাদেশিসহ ৬ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বিদেশি নাগরিক। বর্তমানে সৌদি আরবে ১ কোটি ৬০ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন, যার মধ্যে বর্তমানে ১৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘ সাত বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে আবারো চালু হয় দেশটির শ্রমবাজার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ২০ হাজার ৮০২ জন করে মোট ১ লাখ ৮৭ হাজার ২২৪ বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরব গেছেন। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৪৬ হাজার করে মোট ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন দেশটিতে গিয়েছিলেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, সৌদি রাজপরিবারে অস্থিতিশীলতা, তেলের মূল্য না বাড়া, শ্রমবাজার সৌদিকরণ এবং খাশোগি হত্যা নিয়ে বিদেশি চাপে দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে। এ ছাড়া ১২ সেক্টরে বিদেশি শ্রমিক নিষিদ্ধ করায় পার্টনারশিপের ছোট দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন এসব সেক্টরে কর্মরত থাকলেও পুলিশ ধরছে। ফলে অনেকেই বেকার হচ্ছে এবং তাদের দেশে ফিরতে হবে। এ ছাড়া সৌদি নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো অনেক দেশের চালকরা চাকরি হারাবেন ও ফিরে আসবেন।

২০১১ থেকেই লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের অবস্থান এবং নতুন করে যাওয়ার ওপরে বাংলাদেশ সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে ২০১৫’র দিকে পুনরায় ওই নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে থাকে। কত বাংলাদেশি বর্তমানে লিবিয়ায় আছেন ঢাকায় কর্তৃপক্ষের কাছে তার সঠিক সংখ্যা নেই। গত আগস্ট থেকে দেশটির বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কারণে লিবিয়ার পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার আইওএমের সহায়তায় গত কয়েক মাসে লিবিয়ায় আটকেপড়া বহু বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। নিজ উদ্যোগেও দেশে ফিরেছেন অনেকে।

২০০৮ সালে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ বাংলাদেশি সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মসংস্থানের জন্য গেলেও এর পর থেকে এ হার কমতে কমতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এ সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ২ হাজার ১৬ জনে। ২০০৭ সালে কুয়েত বাংলাদেশি শ্রমিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর দেশটিতে জনশক্তি যাওয়ার হার কমে যায়। তবে ২০১৪ সালের শেষ দিকে আবারো কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় দেশটিতে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত একই সময়ে এ সংখ্যা ২৪ হাজার ৫১৬ জন। এ ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায় কাতার, লেবানন, জর্ডান, বাহরাইনেও। পরিসংখ্যান বলছে, এসব দেশে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক যাওয়ার হারও কমে গেছে।

জনশক্তি রফতানিকারক সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন বলেন, সৌদির বাজার আর আগের মতো নেই। ১২ ক্যাটাগরি নিষিদ্ধ, আকামা ফি বাড়ানোর ফলে যারা ছোট ব্যবসা ও দোকান করতেন তারা চলে আসতে বাধ্য হওয়ায় প্রত্যাবাসন বেড়েছে। এ ছাড়া দেশটিতে যেতে আমাদের শ্রমিকদেরও আগ্রহ কমেছে। সৌদিকরণের ফলে পরিবেশও পাল্টেছে। কাতার বিশ্বকাপ নিয়েও আমরা আশাবাদী ছিলাম। ভেবেছিলাম অনেক লোক যাবে। কিন্তু আশা পূরণ হয়নি। তাছাড়া কাতারে অবরোধের কারণেও সেখানে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নিয়োগ নেই। কুয়েতও এখন আমাদের শ্রমিক নিচ্ছে না। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যাওয়ার হার গতবারের চেয়ে কমেছে। শ্রমবাজার সংকুচিত হলে সেটি যেমন অ্যালার্মিং হবে তাতে শ্রমিকরাও আগ্রহ হারাবে।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসানের মতে, সৌদি আরবে প্রচুর লোক গত বছর গেলেও এদের বেশিরভাগই গিয়েছে তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসা’তে। এই প্রক্রিয়ায় গিয়ে তারা দেখেছে কাজ নেই বা বেতনও সন্তোষজনক নয়। এ কারণে আবার অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফেরত আসা শুরু করেছে। কাজেই আমি মনে করি মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এসে নতুন বাজার খোঁজার প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার।

এদিকে মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের বিরুদ্ধে চলমান মেগা থ্রি সাঁড়াশি অভিযানে ধরপাকড়ে প্রতিদিন শূন্য হাতে দেশে ফিরছেন অসহায় শ্রমিকরা। প্রতিদিনই বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকরাও দেশটিতে আটক হচ্ছেন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে আলোচনার জন্য দেশটির সরকারি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি দল ঢাকায় আসার কথা। এ কমিটির সঙ্গে আলোচনার পর অবস্থা পরিষ্কার হবে।

এ নিয়ে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, সিন্ডিকেটের অভিযোগে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য স্থগিত হয়েছে। জানুয়ারি থেকে আবার নতুন করে শ্রমিক যাওয়ার কথা। দেশটির সরকারি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সঙ্গে আলোচনায় কত কম খরচে শ্রমিক পাঠানো যায় তাকে প্রাধান্য দিতে হবে। নয়তো আমাদের ট্র্যাডিশনাল এ বাজার হুমকিতে পড়বে।

অন্যান্য দেশের শ্রমবাজার নিয়ে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার ছোট হলেও জঙ্গি তকমা লাগার পর দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো ৭০-৮০ ভাগ কমে গেছে। আমাদের শ্রমিকরা সেখানে এয়ারপোর্ট, মোবাইল ট্রান্সমিটিং এরিয়ার মতো সিকিউরিটি জোনগুলোতে ওয়ার্ক পারমিট পাচ্ছে না। ভালো সম্পর্কের কারণে দেশটি মিয়ানমার থেকে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক নিয়েছে। নতুনভাবে ভিয়েতনাম, নেপাল এবং ভারত থেকেও শ্রমিক নিচ্ছে দেশটি। ৪-৫ দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, ছোট বাজার এবং জঙ্গি তকমায় জনশক্তি রফতানি বেশ নাজুক। মধ্যপ্রাচ্যসহ সব শ্রমবাজারে গত বছরের চেয়ে এবার শ্রমিক পাঠানো এক-তৃতীয়াংশ কমতে পারে। এটা আমাদের জন্য ভালো সংবাদ নয়।

জনশক্তি রফতানি কমায় কমছে রেমিট্যান্সও। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীরা দেশে ১১২ কোটি ৭৩ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন, যা আগস্টের চেয়ে ২৮ কোটি ডলার কম। আগস্টে এসেছিল ১৪১ কোটি ১০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ২৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ২০ শতাংশ কম। এটি এই বছরের যেকোনো মাসের চেয়ে সর্বনিম্ন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads