মিয়ানমারে রাখাইন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রথমবারের মতো দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জাতিসংঘ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। গার্ডিয়ান জানিয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের জাতিবিদ্বেষী নীতির কারণে ত্রাণ সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কেনাট ওস্টবি নেপিদোকে চিঠি দিয়ে এ বার্তা জানিয়ে দিয়েছেন।
জাতিসংঘের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়ে যে রোহিঙ্গারা এখনো রাখাইনের শরণার্থী শিবিরে (ইন্টারন্যালি ডিসপ্লেসড পার্সনস-আইডিপি ক্যাম্প) থেকে গেছে, তাদের মৌলিক মানবাধিকার ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
গার্ডিয়ানের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে থাকা অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। ২০১২ সালে রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য স্থাপন করা হয় আইডিপি ক্যাম্প। তখন থেকেই এই ক্যাম্পে সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা ও কামান জনগোষ্ঠীর প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার সদস্য এসব ক্যাম্পে বসবাস করে। তবে তাদের চলাফেরায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে মিয়ানমার সরকার।
মিয়ানমার সরকারকে লেখা চিঠিতে দেশটিতে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেছেন, এখন থেকে চলাফেরার স্বাধীনতাসহ মৌলিক ইস্যুতে বাস্তব উন্নতি হলেই কেবল জাতিসংঘ ও তাদের দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা সরবরাহ করা হবে।
মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আয়ে-কে লেখা ওই চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, পুরনো ‘বন্ধ থাকা’ এবং নতুন তৈরি করা ক্যাম্পগুলোতে একই অমর্যাদাকর পরিস্থিতি চলছে। সেখানকার বাসিন্দাদের মৌলিক সেবা বা জীবিকার সুযোগ নেই। এমনকি দৃশ্যত অপরিবর্তিত থেকে গেছে ক্যাম্পের অবস্থান।
গার্ডিয়ানের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আইডিপি ক্যাম্প বন্ধের কাজ আন্তর্জাতিক মানে আনতে জাতিসংঘ বেশ কয়েক মাস ধরেই মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, এসব নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ওস্টবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও অস্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার। তবে মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক উপমন্ত্রী সোয়ে অং দাবি করেছেন, ওস্টবির চিঠিকে জাতিসংঘের সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি হিসেবে দেখছেন না তারা। তিনি বলেন, জাতিসংঘের সংস্থা এবং আমাদের মন্ত্রণালয় নিবিড় যোগাযোগ রাখছে আর মানবিক সহায়তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য আমরা খোলামেলাভাবে এবং বারবার আলোচনা করছি।
এর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হওয়া এসব মানুষ সেখানকার শিবিরে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। সংস্থাটির ত্রাণবিষয়ক উপ-প্রধান উরসুলা মুলার সে সময় দাবি করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি মনোযোগী হলেও রাখাইনে থেকে যাওয়া ওই চার লাখ রোহিঙ্গা আলোচনার বাইরে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের বাস্তবতাকে প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যা দিয়ে রাখাইন পরিস্থিতি উন্নয়নের তাগিদ দেন তিনি। একপর্যায়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সম্মত হয় মিয়ানমার। ওই কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, স্বেচ্ছায় ও আলোচনার ভিত্তিতে এসব ক্যাম্পে বসবাসকারী ব্যক্তিদের নিজেদের গ্রাম বা আশপাশের সম্ভাব্য কোথাও পুনরায় বাসস্থান তৈরি করে দিতে হবে, যেখানে তারা জীবিকার সুযোগ পাবে। তবে জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন ও মানবিক সংস্থাগুলোর বর্ণনা থেকে গার্ডিয়ান জানতে পেরেছে, আইডিপি ক্যাম্পগুলোতে রুদ্ধশ্বাস বাস্তবতা চলছে। সেখানে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ ও দুর্দশা অপরিবর্তিত রয়েছে। চলাফেরা, জীবিকা উপার্জনের সুযোগ প্রায় পুরোপুরিই অস্বীকার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। জাতিগত নিধনের ভয়াবহ বাস্তবতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশটি বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও জাতিসংঘের হিসাবে ৪ লাখেরও বেশি মানুষ এখনো সেখানে থেকে গেছে।
