• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ভূমধ্যসাগরে প্রতিদিন ৬ প্রাণহানি

ছবি : সংগৃহীত

বিদেশ

ভূমধ্যসাগরে প্রতিদিন ৬ প্রাণহানি

তবু থামছে না মানবপাচার

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৭ জুলাই ২০১৯

জাতিসংঘের গত জানুয়ারিতে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় প্রতিদিন গড়ে ছয়জন প্রাণ হারান। এর মাঝেই ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। ভাগ্য বদলাতে অনেকে দেশি-বিদেশি মানব পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছেন। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে মানব পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশিদের নাম বারবার আসছে। তবু জীবিকার সন্ধানে হরহামেশা ইউরোপের উদ্দেশে দেশ ছাড়ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাহাজ বা নৌকায় চড়ে বসছেন অসংখ্য শরণার্থী। আর উত্তাল সাগরের বুকে একের পর নৌকাডুবিতে প্রাণ যাচ্ছে হাজারো মানুষের।

জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ১৫ হাজার ৯০০ অভিবাসী ও শরণার্থী ইউরোপে পৌঁছেছেন। গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় অবশ্য এবার সংখ্যা ১৭ শতাংশ কম।

এদিকে তিউনিসিয়ার সমুদ্র উপকূলে অভিবাসীদের বহনকারী একটি নৌকাডুবিতে অন্তত ৮০ জনের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ওই নৌকা থেকে চার আরোহীকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে একজনের মৃত্যু হয়। জীবিত তিনজন মালির নাগরিক বলে জানা গেলেও নিখোঁজ বাকিরা কোন দেশের তা জানা যায়নি। এদিকে লিবিয়ার জুয়ারা থেকে অবৈধভাবে ইতালিতে যাওয়ার পথে গত ১০ মে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকা ডুবে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ৩৭ জনই ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক।

বিমান বন্দর সূত্র বলেছে, সম্প্রতি নৌকযোগে ইউরোপ যাওয়ার সময় তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার হওয়া ৬৪ বাংলাদেশির মধ্যে আরো ২৪ জন ফিরেছেন। গত বুধবার বিকালে শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছান। লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র নিশ্চিত করেছে প্রথম ধাপে গত ২১ জুন ফিরেছেন ১৭ জন, দ্বিতীয় ধাপে গত মঙ্গলবার ফিরেছেন ১৫ জন। এ নিয়ে মোট ৫৬ বাংলাদেশি ফিরলেন। বাকি ৮ জন দেশে ফিরতে অসম্মতি জানিয়েছেন। তবে তাদেরও ফেরত পাঠানোর জন্য তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষ ও আইওএমর সঙ্গে যোগাযোগ করছে লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান বলছেন, তিউনিসিয়া ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ৬৪ বাংলাদেশির মধ্যে ২৬ জনের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। এ ছাড়া অন্যদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৫ জন, সিলেটের ৮ জন, শরীয়তপুরের ৩ জন, মৌলভীবাজারের ৩ জন, নোয়াখালীর ২ জন এবং চাঁদপুর, সুনামগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকা, নরসিংদী, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইলের একজন করে রয়েছে। এদিকে গত এক মাসে তিউনিসিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন ৩৩ বাংলাদেশি। এই সংখ্যার মধ্যে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া কর্মীরাও রয়েছে। আর গত ১১ জুন তিউনিসিয়া থেকে ফেরত আসা ৬ কর্মী ছিলেন, যারা তিউনিসিয়া দিয়ে ব্রাজিল হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছিলেন। এরা সবাই কুমিল্লা জেলার বাসিন্দা।

এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথটি হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ওই পথ দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় প্রতি ৫০ জনের ১ জন মারা গেছে। আর এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অন্তত ১৭ হাজার অবৈধ অভিবাসী ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে ঢুকে পড়েছে। এ সময়ে সাগরে হারিয়ে গেছে অন্তত ৪৪৩ জন।

অন্যদিকে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তরের (ইউনিডক) ২০১৮ সালের মানব পাচারবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ৫ শতাংশ নাগরিককে পাওয়া গেছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে মানব পাচারের শিকার হওয়া এসব লোক মূলত ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিক। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার লোকজন বিশ্বের ৪০টি দেশে মানব পাচারের শিকার হয়।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সেভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব তো আছেই। তাই কাজ না থাকলে তারা তো বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করবে। আর একই সঙ্গে নানা ধরনের প্রলোভন, আর নানা দুষ্টচক্র তো আছেই। তারা নিশ্চিত চাকরির প্রলোভন দিচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখছি না। সিগন্যাল তো আগেই ছিল। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় বারবার দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে দুটি চক্র কাজ করে। একটি গ্রুপ আছে, যারা মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয়। সেখানে যারা কাজ করে, তাদের আরো উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে ইউরোপে পাঠানোর ফাঁদ পাতে। তারা ইতালি, স্পেনের কথা বলে। আরেকটি চক্র আছে, যারা বাংলাদেশে বসেই প্রলোভন দেখায়। যারা বাংলাদেশে বসে মানব পাচারের এই কাজ করে, তাদের তো আইনের আওতায় আনা যায়। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। যারা প্রতারণার শিকার হয়ে ফিরে আসেন, তাদের কাজে লাগিয়ে এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।’

প্রবাসী কল্যাণ সচিব রওনক জাহান বলেন, যারা বৈধভাবে বিদেশে কাজে যান, তাদের বিষয়টি আমাদের এখতিয়ার। নিরাপদ অভিবাসনের বিষয়ে আমাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি আরো জোরদার করছি। জেলা থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আমাদের এই কর্মসূচি বিস্তৃত করেছি। মানুষকে সচেতন করা না গেলে এই দুঃখজনক ঘটনা ঠেকানো যাবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads