• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
ভারতের ভাঙন শুরু

ছ বি : সংগৃহীত

বিদেশ

ভারতের ভাঙন শুরু

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ০৬ আগস্ট ২০১৯

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে শুধুই আতঙ্ক আর স্তব্ধতা। মাঝেমধ্যেই বেজে উঠছে সাইরেন। ভারী বুটের শব্দে যেন কেঁপে উঠছে উপত্যকা। ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীরে রোববার থেকেই জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। মোতায়েন করা হয়েছে হাজার হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য। খবর বিবিসি, ডন, এনডিটিভি, আনন্দবাজার  ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার।

বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট ও ডিশ সংযোগ। এই আতঙ্কের মধ্যেই ভারত সরকার গতকাল সোমবার বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাসংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ। এই আইন বাতিল ছাড়াও ভাগ করা হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সব রাজ্যে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীর ইস্যুতে মোদি সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কারণে যেন কোনো রাজ্যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় সেজন্যই এ নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্র। এদিকে পাকিস্তান বলেছে কাশ্মীর ইস্যুতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেবে তারা। 

জম্মু-কাশ্মীরকে দেওয়া বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে ভারতের দেওয়া ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, এ অবৈধ পদক্ষেপ মোকাবেলায় আমরা সম্ভাব্য সব বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কাশ্মীরের ব্যাপারে পাকিস্তান তার অবিচল প্রতিশ্রুতি আবারো নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে কাশ্মীর নিয়ে মোদি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে ভারতের বিরোধী দলগুলোসহ সরকারের শরিক দলগুলোও।

প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বলেছেন, ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ফলে এখন থেকেই শুরু হলো ভারতের ভাঙন। রাজ্যসভা থেকে বেরিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি পুরো দেশকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘এটা যদি জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে করা যায় তাহলে দেশের অন্য রাজ্যগুলোর সঙ্গেও করা হবে। প্রথমে রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে বাতিল করা হবে, তারপর রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হবে। ভেঙে দেওয়া হবে বিধানসভা। বিধানসভার ক্ষমতা যাবে সংসদের হাতে, সরকার সংসদে একটা প্রস্তাব আনবে, সেটাতে সংসদ অনুমোদন দেবে। সার কথা হলো রাজ্য আর থাকবে না।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, প্রত্যেকটা রাজ্যকে এভাবে ভেঙে দেওয়া যাবে এবং দুটি অথবা তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হবে। এই সরকার যদি এই পথেই এগোতে থাকে, তাহলে বলতে হয়, এখন থেকেই ভারতের ভাঙন শুরু হয়ে গেল। বিজেপির শরিক সংযুক্ত জনতা দল এ সিদ্ধান্তে সমর্থন দেয়নি। দলের নেতা কে সি ত্যাগী বলেন, আমরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধী। এটা এনডিএর এজেন্ডা নয়। অন্য রাজনৈতিক দল থেকে বিজেপি নিজেদের আলাদা দাবি করে এসেছে বরাবর। তিনটি বিষয়ে তারা কখনো তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে সরেনি। ৩৭০ ধারা বাতিল, সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন ও অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা।

রাজ্যসভায় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, এর মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানকে হত্যা করা হলো। ভারতের মানচিত্র থেকে একটা রাজ্য আজ মুছে গেল।

জম্মু-কাশ্মীরের দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এবং ওমর আবদুল্লাহ গৃহবন্দি থাকায় তারা গণমাধ্যমের সামনে আসতে পারেননি। রোববার থেকেই তাদেরসহ কাশ্মীরের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু টুইটারে তারা মোদি সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে আগ্রাসন ও জনগণের আস্থার প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, সরকার একতরফাভাবে এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এটি অবৈধ। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ভারত সরকারের একতরফা ও হতাশাজনক সিদ্ধান্তে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের আস্থার সঙ্গে পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই রাজ্য ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। কিন্তু সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পরিণতি হবে সুদূরপ্রসারী ও ভয়াবহ। তারা রাজ্যের জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়েছে।

সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি টুইটারে বলেন, আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের কালো দিন। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যানের এবং ভারতের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত উল্টো ফল দিল। ৩৭০ ধারা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে মোদি সরকার নিয়েছে, তা বেআইনি ও অসাংবিধানিক। এ সিদ্ধান্ত ভারতকে জম্মু-কাশ্মীরে একটি দখলদার শক্তিতে পরিণত করবে। এই সরকারের উদ্দেশ্য অশুভ। তারা চায় জম্মু ও কাশ্মীরের জনতত্ত্বই বদলে দিতে।

প্রসঙ্গত, নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতির কথা বলে গত সপ্তাহে কাশ্মীরে আধাসামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত ৩৫ হাজারেরও বেশি সদস্য মোতায়েন করা হয়। শুক্রবার সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, অমরনাথের তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের দ্রুত রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। ওই ঘোষণার পরেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর এসব বাড়তি সদস্যকে রাজ্যের রাজধানী শ্রীনগর এবং কাশ্মীর উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে এমনকি গ্রামাঞ্চলেও মোতায়েন করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মোবাইল ইন্টারনেট। নিষিদ্ধ করা হয়েছে সভা-সমাবেশ। সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও স্পর্শকাতর এলাকায় কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। রোববার মধ্যরাত থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে শ্রীনগরে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেখানকার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ছাত্রাবাস খালি করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীর পুলিশের দাবি, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এছাড়াও সোমবার জম্মু-কাশ্মীরকে দেওয়া বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘোষণার পর সেখানে আধাসামরিক বাহিনীর আরো ৮ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে মোদি সরকার। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসব সেনাকে সেখানে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি সেদেশের সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে। ভারত সরকার দাবি করছে, রাজ্যে উচ্চ মাত্রার জঙ্গি হুমকি ঠেকাতে বিপুল সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, ২৯ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিন দিন ধরে জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণরেখা পার হওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এর মধ্যে ৪-৫টি প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।

বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায় কাশ্মীরকে দেখেন ‘একটি পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকরণকৃত এলাকা’ হিসেবে। ২০১৩ সালে আফজাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক শীর্ষক নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন, এখানে (কাশ্মীরে) রয়েছে ভারতের পাঁচ লাখ সৈনিক। প্রতি চারজন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে একজন সৈন্য! আবু গারিবের আদলে এখানকার আর্মি ক্যাম্প ও টর্চার কেন্দ্রগুলোই কাশ্মীরিদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বার্তাবাহক। এরপর আরো ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কাশ্মীর সংকটের সমাধানে সেখানে সেনা-সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়েছে। দমনপীড়নের পথেই হেঁটেছে ভারতীয় বাহিনী।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads