• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
এবার আইসিজের রায়ের অপেক্ষা

সংগৃহীত ছবি

বিদেশ

রোহিঙ্গা গণহত্যা

এবার আইসিজের রায়ের অপেক্ষা

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা বাতিল করার আর্জি জানিয়েছেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি। মিয়ানমারের সামরিক বিচার কাঠামোকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন এ নোবেলজয়ী। অন্যদিকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ আনা গাম্বিয়ার প্রধান কৌঁসুলি পল রিখলার বলেছেন, রাখাইনে নৃশংসতার জন্য দায়ী সেনাসদস্যদের বিচার ও সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখা যায় না।

দ্য হেগের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) এ মামলার শুনানির শেষ দিন গত বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত যুক্তিতর্কে দুই পক্ষের এমন বক্তব্য আসে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়। তিন দিনের শুনানি শেষে আইসিজের বিচারক প্যানেলের প্রধান আবদুলকাভি আহমেদ ইউসুফ বলেছেন, যতদ্রুত সম্ভব এ মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন তারা। তবে সে জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।

দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করার অভিযোগে মিয়ানমারকে জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ আদালতে এনেছে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া।

গত মঙ্গলবার দ্য হেগের পিস প্যালেসে গাম্বিয়ার পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করতে এসে দেশটির আইনমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং গণহত্যা বন্ধের দাবি জানান। এরপর বুধবার মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিতে এসে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে গাম্বিয়া যে চিত্র এ আদালতে উপস্থাপন করেছে তা ‘অসস্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’।

তৃতীয় ও শেষ দিনের শুনানিতে বৃহস্পতিবার দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনে আইসিজের ১৭ সদস্যের বিচারকের প্যানেল।

গাম্বিয়ার প্রধান কৌঁসুলি পল রিখলার মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আগ পর্যন্ত বিচারকদের কাছে বারবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাময়িক পদক্ষেপ দাবি করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা শুনানির সময় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বর্বর নির্যাতনের অভিযোগ বা ২০১৭ সালের অভিযানের পর রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে দেশান্তরের অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টাও করেননি।

রাখাইনে সামরিক বাহিনীর অভিযানে কোনো অন্যায় হয়ে থাকলে সেনাসদস্যদের বিচারের ব্যবস্থা করার যে প্রতিশ্রুতি মিয়ানমার দিচ্ছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিচারক প্যানেলের উদ্দেশে রিখলার বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর দায়ে তাতমাদোকে (মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) বিচারের মুখোমুখি করা হবে-এটা কীভাবে আশা করতে পারে কেউ, যখন সেনাবাহিনী প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ ছয় শীর্ষ জেনারেলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গণহত্যার অভিযোগ তুলে তাদের ফৌজদারি বিচারের সুপারিশ করেছে?

গণহারে হত্যা, ধর্ষণ এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি নির্মূল করাই যে ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে সেনা অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, তা পরের বছর জাতিসংঘের স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে। সেনাবাহিনীর ওই সাঁড়াশি অভিযানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ নিহত হয় বলে তদন্তকারীদের ধারণা। আর প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা গণহত্যার অভিপ্রায়কে অন্যকিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।

আর অং সান সু চির বেসামরিক সরকার বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উসকে দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করেছে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকারও নৃশংসতায় ভূমিকা রেখেছে।

আইসিজের শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে যুক্তি খণ্ডনে দাঁড়িয়ে সু চি বলে, রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে কি না, সেই বিচারের এখতিয়ারই জাতিসংঘের এ আদালতের নেই। তিনি দাবি করেন, সেনাসদস্য বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ থাকলে মিয়ানমার তা তদন্তের পর দায়ীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করে থাকে।

তার ভাষ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ওই ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকলেও সেগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে না এবং ১৯৪৮ সালের কনভেনশনের অধীনে তার বিচার করা যায় না।

সু চি বলেন, এ আদালতের তালিকা থেকে এ মামলা বাদ দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছে মিয়ানমার। গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার যে আবেদন করা হয়েছে, তা খারিজ করা উচিত। আগের দুদিনের মতো বৃহস্পতিবারও দুই পক্ষের লোকজন দ্য হেগের পিস প্যালেসের বাইরে জড়ো হয়ে নানা স্লোগানে নিজেদের দাবি তুলে ধরেন।

মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়ার সময় সু চির সমর্থকরা স্লোগান ধরেন- ‘মা সু, ভালো থেকো’। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের পক্ষের দল ‘অং সান সু চি, শেইম অন ইউ’-স্লোগান দিতে থাকে।

ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলাটি করা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে, সু চির বিরুদ্ধে নয়। আইসিজে কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সাজা দিতে পারে না, যেমনটি পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। আইসিসি আলাদাভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তদন্ত করছে।

আইসিজের বিধি অনুসারে, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ তুলতে পারে। গাম্বিয়ার করা এ মামলায় গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তি বিধানে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষরিত কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ১৯৫৬ সালে ওই জেনোসাইড কনভেনশনে সই করেছিল মিয়ানমার।

গাম্বিয়াও এ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। এই কনভেনশনের আওতায় দেশগুলো শুধু গণহত্যা থেকে বিরত থাকাই নয় বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা এবং এমন অপরাধের জন্য শাস্তি বিধানেও বাধ্য। এই আদালতের সিদ্ধান্ত মানার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে এবং এর বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। যদিও সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা নেই এ আদালতের এবং সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার বহু উদাহরণ রয়েছে।

গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে ‍শুনানিতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে কিছু অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার আর্জি জানানো হয়। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা এবং গণহত্যার আলামত সংরক্ষণের আদেশ চাওয়া হয় আইসিজের কাছে।

মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়েছে কি না-সে বিষয়ে রায় দিতে হলে আদালতে এটা প্রমাণ হতে হবে, রাষ্ট্রটি রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করেছে। তবে সেটা যদি প্রমাণও হয় তবুও অং সান সু চি কিংবা মিয়ানমারের জেনারেলদের গ্রেপ্তার করা কিংবা তাদের বিচার করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে না আইসিজে।

মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ আসতে পারে। এতে মিয়ানমার বিশ্বে ভাবমূর্তি হারানো এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের ১৫ বিচারকের সঙ্গে প্যানেলে আছেন গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মনোনীত দুই বিচারক। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads