• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার চায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন

প্রতীকী ছবি

বিদেশ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার চায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ০৩ মার্চ ২০২১

স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়েছে কয়েক দশক আগে। এখন বিশ্বে চলছে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু এতে থাবা বসাতে উদ্যত হয়ে আছে চীন। এ নিয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। সরাসরি বা শীতল যুদ্ধের মতো কোনো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি না হলেও উভয় দেশই নানা কৌশলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে। এ দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এ নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।

এতে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের কোনো চিহ্ন না থাকায় পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লোকেরা ইতোমধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি পৃথক মেরু হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। সম্প্রতি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরা প্ল্যাকার্ডগুলোতে সেনাশাসকদের সমর্থন করায় চীনকে আক্রমণ এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। 

এ অঞ্চলের সরকারগুলো চীন না যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেবে, তা নিয়ে মারাত্মক চাপের মুখে রয়েছে। ২০১৬ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে অবশ্য পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে ঠেলে চীনের দিকে আগাচ্ছেন। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য দাবি নিয়ে এ অঞ্চলের প্রধান জোট আসিয়ানেও বেশ উচ্চবাচ্য হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্যের এই লড়াই আরো জোরদার হবে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, চীনের কাছে কৌশলগতভাবে এ অঞ্চলের গুরুত্ব ব্যাপক। এটি চীনাদের একেবারে দোরগোড়ায়, তার ওপর তেল, অন্য কাঁচামাল আমদানি ও তৈরি পণ্য রপ্তানির বড় রুট। পূর্ব দিকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইয়ানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা থাকায় তা নিয়ে সব সময় তটস্থ তাকতে হয় চীনকে। সে তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনেকটাই শান্তশিষ্ট। এ পথ দিয়ে চীনারা সহজেই ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হয়ে ওঠার মাধ্যমেই এ অবরোধ-আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে পারে চীন।

তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শুধু অন্যত্র যাওয়ার পথে সামান্য স্টেশন ভাবলে ভুল হবে। এখানে প্রায় ৭০ কোটি লোকের বসবাস-যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, লাতিন আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের চেয়েও বেশি। সম্মিলিতভাবে একে যদি একটি অর্থনৈতিক শক্তি ধরা হয়, তাহলে সেটি হবে বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পরেই বৃহত্তম অর্থনীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। এটি বাড়ছেও অত্যন্ত দ্রুত। এ অঞ্চলকে ঘিরে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠার এটি অন্যতম একটি কারণ।

গত এক দশক ধরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অর্থনীতি বাড়ছে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ হারে। ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে বাড়ছে ছয় থেকে সাত শতাংশ। মিয়ানমার-কম্বোডিয়ার মতো এ অঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতি বাড়ছে আরো দ্রুত। চীনবিমুখ বিনিয়োগকারীদের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্রও হয়ে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এ অঞ্চলের উদ্যোক্তারা এখন লোভনীয় বাজার ধরতে প্রস্তুত।

বাণিজ্যের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া একটি পুরস্কারস্বরূপ। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, দুই প্রধান প্রতিযোগীর মধ্যে সেই পুরস্কার হাতিয়ে নিচ্ছে চীনারাই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনারা অনেক বেশি বিনিয়োগ করে থাকে। এখানকার অন্তত একটি দেশ-কম্বোডিয়া, ইতোমধ্যেই সব দিক থেকে চীনের আওতাধীন। অন্য দেশগুলোর মধ্যেও কেউ চীনকে ডিঙিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকবে না।

যদিও চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই বন্ধনে অনেক ফাঁক-ফোকর রয়েছে। চীনা বিনিয়োগ বিপুল হলেও তাতে ঘাটতি রয়েছে। দুর্নীতি বা পরিবেশগত ঝুঁকি অগ্রাহ্য করার অভিযোগ রয়েছে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। তাদের অনেকেই আবার স্থানীয়দের বাদ দিয়ে চীনা কর্মী নিয়োগ দিতে আগ্রহী। ফলে অর্থনৈতিক লাভ কমে যাচ্ছে। তাছাড়া, সামান্য মনেঃক্ষুণ্ন হলেই চীনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বদঅভ্যাস অন্য দেশগুলোর জন্য আতঙ্কের কারণ।

প্রতিবেশীদের ওপর চীনা সামরিক বাহিনী ছড়ি ঘোরানো ভালো চোখে দেখছে না এ অঞ্চলের দেশগুলো। দক্ষিণ চীন সাগর দখলের পাশাপাশি আশপাশের জলসীমায় মাছ ধরা বা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নৌযানগুলোকে চীন নিয়মিত হয়রানি করছে। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি দেশেরই ঝামেলা রয়েছে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারবিরোধীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে চীনাদের। এসব কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন অনেকটাই অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ভিয়েতনামে প্রায়ই চীনবিরোধী বিক্ষোভ হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ ইন্দোনেশিয়ায় অবৈধ চীনা অভিবাসন ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের সঙ্গে চীনের আচরণের বিরোধিতায় বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে। এমনকি লাওসের মতো ছোট্ট দেশেও চীনবিরোধী আওয়াজ শোনা যায়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতারা হয়তো অর্থনৈতিক কারণে সরাসরি চীনের সমালোচনা করতে সাহস পাবেন না। তবে খুব বেশি চীনঘনিষ্ঠ হওয়া নিয়ে জনগণের ক্ষোভের বিষয়টিও তাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে।  ফলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনাদের জন্য আধিপত্যের নিশ্চয়তা এখনো বহুদূর। এ অঞ্চলের দেশগুলো ধনী প্রতিবেশীর বিনিয়োগের লোভ না ছাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন তারাও প্রত্যাশা করে। দুই পরাশক্তির আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কী কী সুবিধা বের করে আনতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads