সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে রোববার গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে মুখোশ পরে তাণ্ডব চালায় একদল দুষ্কৃতকারী। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাত পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে উপাচার্যের বাসভবনে ওই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। তাণ্ডব থামার পর উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীকে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। উপাচার্যের সঙ্গে পাঁচ মিনিটের মতো কথা হয় প্রধানমন্ত্রীর। পাশাপাশি চারুকলার সামনে থাকা নববর্ষ উদযাপনের উপকরণের ওপরও দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায়।
এই হামলা-ভাঙচুর নিয়ে ইতোমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ৫২ বছরের মধ্যে এমন হামলার ঘটনা কেউ দেখেনি।
হামলার পরদিন সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেছেন, আমার বাসায় যারা এসেছিল তারা মুখোশ পরে লাশের রাজনীতি করতে এসেছিল। দেশকে অস্থিতিশীল করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
আন্দোলনকারীরা বলেছেন, এই ভাঙচুরে যারা জড়িত তারা কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনের কেউ নন। অন্য কেউ এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। সিসি ক্যামেরার ছবি দেখে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বলেছে, বিক্ষোভের মধ্যে গভীর রাতে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উপাচার্যের বাসভবনে বহিরাগতরা হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছে সমিতি। ঢাবি ক্লাবে সমিতির সংবাদ সম্মেলনে ‘বর্বরোচিত হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার’ সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত বিচারের দাবি জানানো হয়।
সমিতির সভাপতি প্রফেসর মাকসুদ কামাল বলেন, গুজব ছড়িয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। আন্দোলনকে ধ্বংসাত্মক করতে, সরকারকে বিব্রত করতেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়।
তিনি বলেন, চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি সংস্কার দাবিতে আন্দোলন চলাকালে রাতে সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলতে আসেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন, সোমবার সকালে বৈঠকের কথাও জানান। কিন্তু এরপরেই শুরু হয় ভাঙচুর, তাণ্ডব।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন শিবলী রুবায়েতুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনের নামে ভাঙচুর কেন? যারা তাণ্ডব, ভাঙচুর চালিয়েছে তারা আমাদের ছাত্র কিংবা আন্দোলনকারী- তা বিশ্বাস করি না। বহিরাগতরা মুখোশ পরে হামলায় অংশ নেয়। তারা ঢাবির কেন্দ্রীয় সিসি ক্যামেরার কন্ট্রোল রুমেও হামলার চেষ্টা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটা সংস্কারের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনে উপাচার্যের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা অন্যমাত্রা বহন করে। উপাচার্য, আন্দোলনকারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ সব পক্ষই বলছে, ভাঙচুরকারীরা সাধারণ শিক্ষার্থী নয়। তাহলে ওরা কারা? কেন মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়ি ভাঙচুর করল? কী উদ্দেশ্য ছিল তাদের? মূলত এসব প্রশ্নই সব মহলে ঘুরপাক খেয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সোমবার মন্ত্রিপরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু উপাচার্যের বাড়ি ভাঙচুরকারীদের হদিস পাওয়া যায়নি।
বিকালে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, এই হামলার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় আইনগত ব্যবস্থা নেবে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শাহবাগ থানা পুলিশ জানায়, উপাচার্যের বাড়ি ভাঙচুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিকাল পর্যন্ত কোনো অভিযোগ করা হয়নি। বিকালে শাহবাগ থানার সামনে এক ব্রিফিংয়ে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, তদন্ত না করে এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলা যাবে না। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেছেন, আন্দোলন থামানোর পর পুলিশ খুঁজে বের করবে কারা ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত।
গণজাগরণ মঞ্চের ডা. ইমরান এইচ সরকার একজন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এরপরই একদল দুষ্কৃতকারী দোতলা ওই বাসভবনে ঢুকে প্রতিটি কক্ষের জানালার কাচসহ প্রায় প্রতিটি আসবাবপত্র ও ভাঙার মতো প্রায় সবকিছুই ভেঙে ফেলে। এমনকি বাথরুম ও রান্নাঘরও তারা তছনছ করে। ঘটনার আলামত মুছে ফেলতে ভবনের সিসি ক্যামেরাগুলোও ভেঙে ফেলা হয়।
ভিসির বাসভবনের কর্মচারী আবদুল্লাহ আল মমিন জানান, হামলাকারীদের হাতে লাঠিসোটা ও বাঁশ ছিল। পরিবারের সদস্যরা পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেও উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান সেখানেই ছিলেন। উপাচার্যের বাসভবনে থাকা চারটি গাড়ির মধ্যে দুটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, দুটি ভাঙচুরের শিকার হয়। ভবনের সামনে কয়েকটি মোটরসাইকেলেও আগুন দেওয়া হয়।
সকালে ভবনের ফটক দিয়ে প্রবেশ করার পর থেকেই রাতের তাণ্ডবের চিহ্ন দেখা যায়। ফুলের গাছ ও টব ভাঙা অবস্থায় ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায় লনে। বাসভবনের সামনে কিছু চেয়ার-টেবিল পড়ে থাকতে দেখা যায় পোড়া অবস্থায়। পাশাপাশি পুড়িয়ে দেওয়া হয় দুটি গাড়ি।
ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি শিক্ষামন্ত্রীর : কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কোটা সংস্কারের আন্দোলনের নামে ভাঙচুর, হামলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
৫২ বছরের মধ্যে এমন হামলা হয়নি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামানের বাসভবনে যে জঘন্য হামলার ঘটনা ঘটেছে তা দেখে হতভম্ব সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, যেভাবে ভাঙচুর ও পোড়ানো হয়েছে তা সমাজে ভাবনার উদ্রেক করে। তিনি সোমবার দুপুরে উপাচার্যের বাসভবন পরিদর্শন এবং তার পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানানোর পর গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে নিজ অনুভূতি প্রকাশ করেন। এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ছাত্র হিসেবে, সিন্ডিকেট মেম্বার, টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ভিসি হিসেবে ১৯৬৪ সাল থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমি জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ৫২ বছরের জীবনে কোনো উপাচার্যের বাসভবনে এমন ন্যক্কারজনক হামলা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ভিসির বাসভবনে হামলা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে সাবেক এই ভিসি জানান, সম্ভবত ১৯৮৪ সালে তৎকালীন ভিসি শামসুল হুদা রংপুরের একটি কলেজ পরিদর্শনে গেলে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় তার বাড়ির সিঁড়িতে আগুন লাগানো হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যাকারীদের একজন বাইরে থেকে তৎকালীন ভিসির বাসভবনে ওপেন ব্রাশফায়ার করে। ওই সময় ভিসি পেছন পথে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান।
এদিকে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, নজিরবিহীনভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে ভাঙচুর, হামলা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কোনো সম্পর্ক নেই।