• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

বাংলাদেশ

স্বাগত ১৪২৫

  • রেজাউল করিম লাবলু ও শরীফ খিয়াম
  • প্রকাশিত ১৪ এপ্রিল ২০১৮

শুভ নববর্ষ। বিশ্বের সকল বাঙালির মুখে মুখে এই শব্দযুগল। কারণ আজ পহেলা বৈশাখ, ৪৩৬ বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ী বাংলা বছরের প্রথম দিবস। অতীতের হতাশা-গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে বরণ করার প্রত্যয় নিয়ে প্রতিবছরের মতোই এ দিনটি উদযাপন করছে বাংলাদেশ। আজ ভোরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রা শুরু করেছে নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৫। সরকারি ছুটির দিন আজ। বর্ণিল উৎসবে মুখর হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। এর আগে গতকাল শুক্রবার চৈত্রসংক্রান্তির নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সদ্য সমাপ্ত বছরকে বিদায় জানানো হয়। 

নববর্ষ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আন্তর্জাতিক নেতারাও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন-রেডিও এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। ক্রোড়পত্র ও বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে দেশের সংবাদপত্রগুলো। বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

ইতিহাসবেত্তাদের মতে, মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে ৯৯৮ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত ‘বাংলা সনে’ বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস নির্ধারণ করা হয়। এর আগে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে চালু হওয়া শকাব্দ অনুযায়ী চৈত্র ছিল বছরের প্রথম মাস। তবে অনেক গবেষক আবার দাবি করেছেন, অতীতে আমাদের নববর্ষের প্রথম দিন ছিল পহেলা অগ্রহায়ণ। বহু সংশোধন ও পরিমার্জনের পর ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন থেকে বর্তমানে বিদ্যমান ‘বাংলা সন’কে স্বীকৃত দেয় বাংলাদেশ সরকার। সেই থেকে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল রাষ্ট্রীয়ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়। গত বছর থেকে ‘বৈশাখী বোনাস’ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

অসাম্প্রদায়িক এই বার্ষিক উৎসব দেশের মানুষের জীবনে শুধু আনন্দই বয়ে আনে না, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধনের অনন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়। আজ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরসহ রাজধানীর সর্বত্রই ভোর থেকে বৈশাখী উন্মাদনায় উচ্ছ্বসিত থাকবে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীসহ সব শ্রেণি-পেশা ও ধর্মের মানুষ। তবে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারো সব ধরনের উন্মুক্ত অনুষ্ঠান বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করতে বলেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। শুধু সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলছে। উদযাপন নির্বিঘ্ন করতে কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ডিএমপি। নিষিদ্ধ করেছে ভুভুজেলা বাঁশি, মুখোশের ব্যবহার। এ ছাড়া অনুষ্ঠানস্থলগুলোয় ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ঢাকায় এবারো বর্ষবরণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন ছায়ানটের উদ্যোগে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান। ১৯৯৯ সালে বোমা হামলার শিকার হওয়া এই আয়োজনে এবার ধ্বনিত হবে মানবতার বাণী। বরাবরের মতো ভোর সোয়া ৬টায় সুরেলা ‘রাগ-আলাপ’ দিয়ে শুরু হবে এ অনুষ্ঠান। সবার মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলার প্রত্যয়ে এবারের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম ধার করা হয়েছে লালনের কাছ থেকে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ স্লোগান নিয়ে সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর আগে সকাল পৌনে ৮টায় শাহবাগে শিশুপার্কের প্রবেশদ্বারের নারকেল বীথি চত্বরে বিশেষ বৈশাখী অনুষ্ঠান শুরু করবে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী।

দিনব্যাপী নানা আয়োজন আছে বাংলা একাডেমির। সকাল ৭টা থেকে একাডেমির নজরুল মঞ্চসহ বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে একক বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গীত অনুষ্ঠান শুরু হবে। এ ছাড়া থাকছে বইয়ের আড়ং। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এবং বাংলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে বিকাল ৪টায় শুরু হবে ১০ দিনব্যাপী এই মেলা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বিকাল ৫টা থেকে একাডেমির নন্দনমঞ্চেও রয়েছে নববর্ষের অনুষ্ঠান। এতে দেশের খ্যাতনামা সব শিল্পী সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি পরিবেশন করবেন। গানের স্কুল সুরের ধারার অনুষ্ঠানে থাকবে বাংলাদেশ ও ভারতের খ্যাতিমান শিল্পীদের নাচ, গান, আবৃত্তি, নৃত্যনাট্য ও সেমিনার।

দেশের সব বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনসহ আলোচনা সভা ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করছে স্থানীয় প্রশাসন। শিশু একাডেমি, গণগ্রন্থাগার ও সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটগুলো নানা অনুষ্ঠান করবে। বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।

নববর্ষের প্রথম দিনে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের নিয়ে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে। একইরকম আয়োজন আছে কারাবন্দিদের জন্যও। তাদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ব্যবস্থাপনায় জাদুঘর ও প্রত্নস্থানগুলো আজ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে। শিশু-কিশোর, প্রতিবন্ধী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিনা টিকেটে এগুলো পরিদর্শন করতে পারবে।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। দেশের অভিজাত হোটেল ও ক্লাব বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের আয়োজন করেছে। হোটেল সোনারগাঁও, র্যাডিসন, ওয়েস্টিন, ঢাকা রিজেন্সিসহ হোটেল-রেস্টুরেন্টেগুলোর উদ্যোগেও উদযাপিত হচ্ছে নতুন বাংলা বছরের উৎসব। ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাবের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নেওয়া হয়েছে নানা আয়োজন। মোবাইল অপারেটরগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিও নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বত্রই আজ ধ্বনিত হবে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।

প্রতিবাদী চেতনায় বৈশাখ : আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদের অপশাসনের প্রতিবাদে চারুকলা থেকে বের করা শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটি এখন পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ। এর আগে ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ায় সংস্কৃতির এ উৎসমুখটি ফের অবরুদ্ধ হয়ে যায়। অবশেষে বাঙালির চেতনার তীব্র চাপে ১৯৬৪ সালে পুনরায় প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। সেদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত নববর্ষের অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব জনগণের সমাবেশ হয়। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও বাংলা একাডেমির বটতলায় সেদিন ‘ঐকতানের’ অনুষ্ঠানে এত দর্শক-শ্রোতার সমাগম হয় যে, তৎকালীন দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভার’ বিস্ময় প্রকাশ করে।

হারিয়ে গেছে হালখাতা : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নববর্ষের অন্যতম প্রধান আয়োজন হালখাতা। লাল মোড়ক আর সাদা পাতার এই খাতার সূত্রে বৈশাখী উৎসবের সঙ্গে লাল-সাদার রঙ দুটো জড়িয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। লালকে নতুন উদ্যম-উদ্দীপনা আর সাদাকে শুদ্ধতার প্রতীক মনে হয়। অনেকের মতে, এটা হিন্দুয়ানির প্রভাব। তবে শুরু থেকেই এটি সর্বজনীনভাবে সমাদৃত হয়েছে। যদিও পঞ্জিকামতের কারণে বিভক্ত অবিভক্ত আদি বাংলার দুই পাশে এখন আর একই দিনে বর্ষবরণ হয় না। ভারতের মধ্যে থাকা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা রোববার নববর্ষ পালন করবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads