• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ

র‌্যাব ডিবি ধরে, মুচলেকা নিয়ে ছাড়ে থানা!

অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছেন কয়েক হাজার বিদেশি

  • জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ
  • প্রকাশিত ২২ এপ্রিল ২০১৮

অনুমোদন ছাড়া কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করছেন কয়েক হাজার বিদেশি নাগরিক। তাদের কারোরই বাংলাদেশে কাজ করার প্রয়োজনীয় অনুমতি নেই। ভ্রমণ বা অন্যান্য ভিসায় আসা বিদেশিরা অবৈধভাবে কাজ করছেন এসব শিবিরে। এতে একদিকে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে স্থানীয়দের। ফলে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে এলাকাবাসীর মধ্যে। র্যাব, পুলিশ মাঝেমধ্যেই অভিযান চালিয়ে শিবিরে কর্মরত বিদেশিদের আটক করছে। আবার বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করার শর্তে ছেড়েও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

অবৈধভাবে কাজ করার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার ১৬ বিদেশি নাগরিককে আটকের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বৃৃৃৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফে দুটি বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে র্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের আটক করে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করেন। এ বিষয়ে উখিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার চাইলাউ প্রু মামরা জানিয়েছেন, আটক বিদেশিদের বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করার শর্তে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আটকদের মধ্যে দুজন জার্মানির, ছয়জন যুক্তরাজ্যের এবং আটজন যুক্তরাষ্ট্রের। গত ১১ মার্চ অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করার অভিযোগে ডিবি পুলিশ ৩৯ জন বিদেশি নাগরিককে আটক করে। তাদেরও একই ধরনের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগেও গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশের সময় নারীসহ ১১ বিদেশিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের কাছে দিয়েছিল র্যাব। ওই সময় তাদের সঙ্গে পাসপোর্টও ছিল না। ওই দিন রাতেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

র্যাব সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খবর পায় যে, বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিক পাসপোর্টবিহীন ও কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ থানাধীন বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে ১৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্কোয়াড্রন লিডার মো. রেজাউল হক ও মেজর মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে র্যাব-৭-এর একটি আভিযানিক দল ও ডিবি-ডিএসবির সহায়তায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ থানাধীন এলাকায় দুটি বিশেষ চেকপোস্ট স্থাপন করে তল্লাশি কার্যক্রম চালায়। তল্লাশিকালে কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র ও পাসপোর্ট না থাকায় মোট ১৬ জন বিদেশি নাগরিকের বাংলাদেশে অবস্থানের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়। তারা হলেন জার্মানির নাগরিক ও নাফ রেডিও কমিউনিটি ৯৯.২ এফএম’র মার্শাল ও অ্যান্ডরুস লাঙ্গ, মার্কিন নাগরিক ও বেসরকারি সেবা সংস্থা এসএএলটিএফএলআই’র এনটওনিটি মেরি ও আন্ড্রে লুনিসিয়া, হেল্প দ্য নিডির স্যামুয়েল কে হাসলাম, মেডিলাইন বেলী হাসলাম, টাটুম এডলি নেলসন এবং ট্রাসি মিচেল হাসলাম, মালাইসা ডান নেলসন, জন স্টিভেন ইভলিন, যুক্তরাজ্যের নিজার নাগিব দাহান, মার্কাস জেমস ভ্যালান্সি, মাজাফার, খালিদ হোসাইন, ইফতেখার মাসুদ এবং ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিলের লিন্ডসে গ্রিম সু।

একইভাবে গত ১১ মার্চ ডিবি পুলিশ উখিয়া প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে ৩৯ বিদেশি নাগরিককে আটক করে। বৈধ অনুমতি নিয়ে কাজ করার শর্তে পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিন আটকদের মধ্যে ফ্রান্সের ৫, কানাডার ২, যুক্তরাষ্ট্রের ৬, থাইল্যান্ডের ১, তুরস্কের ৫, মালয়েশিয়ার ৪, ইন্দোনেশিয়ার ৩, জাপানের ২, ডেনমার্কের ১, ভারতের ১, কেনিয়ার ৩ ও গ্রিসের ১ জন নাগরিক ছিলেন। তারা সবাই সাহায্য সংস্থা এমএসএস, এসিপি, রিলিফ ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করেন।

এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশের সময় নারীসহ ১১ বিদেশিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের কাছে দিয়েছিল র্যাব। এদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের দুজন, নেদারল্যান্ডসের একজন, তুরস্কের একজন, দক্ষিণ কোরিয়ার একজন, ইতালির দুজন, ব্রাজিলের একজন, বেলজিয়াম ও নরওয়ের একজন নাগরিক ছিলেন। ওই সময় তাদের সঙ্গে পাসপোর্টও ছিল না। ওইদিন রাতেই তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক হাজার বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন এনজিও সংস্থার মাধ্যমে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ ক্যাম্পে কাজ করছেন। অভিযোগ উঠেছে এসব বিদেশি নাগরিক তাদের চাকরি দীর্ঘস্থায়ী করতে সেবার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ফেরত না যেতে উদ্বুদ্ধ করছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন এনজিওতে বিদেশিদের কাজ করার বিষয়ে কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকারের নিয়মনীতি মেনে এনজিওগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদেশিদের কাজ করাতে পারে। কিন্তু এখানে সচেতনতার অভাবে হয়তো অনেক বিদেশি যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছেন। আমরা এনজিওগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন করছি, যাতে নিয়মনীতি অনুসরণ করে। এরপরও কোনো কোনো এনজিও তা মানছে না। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তা ছাড়া ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে যেসব এনজিও বিদেশিদের কাজ করাচ্ছে তাদের প্রতি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক এমপি ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদেশিদের ওপর নজরদারি বাড়ানো দরকার। তিনি আরো বলেন, অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলিম বিদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।’

উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, র্যাব অবশ্যই প্রশংসনীয় কাজ করেছে, কিছু বিদেশি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা পল্লী বা আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার দিবাস্বপ্ন দেখছে। তারা নিজেদের চাকরি স্থায়ী করতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে না যেতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছে, যা আমরা বেঁচে থাকতে হতে দেব না। তিনি বিদেশিদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ করারও দাবি জানিয়ে বলেন, সরকারকে এ বিষয়ে পরিষ্কার পদক্ষেপ নিতে হবে। না হয় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্যসচিব ও পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বনভূমি ধ্বংস করে গড়ে তোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদেশিরা বিনা অনুমতিতে কাজ করছে। আর ওখানেই এখন এলাকাবাসী ঢুকতে পারে না তাদের অনুমতি ছাড়া। যেন এটি মগের মুল্লুক। এভাবে এদের ছেড়ে দেওয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।

র্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন জানান, ১৯ এপ্রিল আটকদের মধ্যে ১২ জনের পাসপোর্ট ও ভিসা সঙ্গে ছিল না। বাকি ৪ জনের বিজনেস ও ট্যুরিস্ট ভিসা থাকলেও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) অনুমতি ছাড়া তারা টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছিল, যা আইনত অবৈধ। উখিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার চাইলাউ প্রু মারমা জানিয়েছেন, আটক বিদেশিদের যাছাই-বাছাই শেষে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বিদেশিকে বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নিয়েই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads