• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা  দিলেন বেঁচে যাওয়া ইয়াসমিন

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ

বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিলেন বেঁচে যাওয়া ইয়াসমিন

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২০ মার্চ ২০১৯

পাহাড়ের কোলে বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সারা দিন ভোট হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে, সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে ফেরার পথে পাশের উঁচু পাহাড় থেকে ছুটে এলো গুলি।

রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি-দিঘিনালা সড়কের নয় মাইল এলাকায় সোমবার সন্ধ্যার ওই হামলা কেড়ে নিয়েছে দুই ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ সাতজনের প্রাণ। সবুজ পাহাড়ে এই সহিংসতা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে।

দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বিবদমান পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে হানাহানি আর হত্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু রাস্তার ওপর অ্যামবুশ করে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের এভাবে হত্যার ঘটনা নজিরবিহীন।

দেশের বিভিন্ন স্থানের ১১৫টি উপজেলার সঙ্গে বাঘাইছড়ি উপজেলাতেও গত সোমবার ভোট হয়। তবে পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত প্রার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে সকালেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। এরপর সন্ধ্যায় ঘটে ওই হত্যাকাণ্ড।

সেখানে ঠিক কী ঘটেছিল, তার হূদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম ব্লক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার। নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও চোখের সামনে সহকর্মীদের খুন হতে দেখার পর স্বাভাবিক হতে পারছেন না তিনি।

পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে ইয়াসমিনকে পাঠানো হয়েছিল বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। দুর্গম পাহাড়ে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রোববার দুপুরেই তারা কেন্দ্রে পৌঁছে যান। সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়েই ভোট শুরু হয়।

তিনি বলেন, ‘পুরোটা সময় বেশ ভালোভাবে সব হচ্ছিল। ভোটাররা এসে ভোট দিচ্ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়। এরপর আমরা গণনাও শেষ করি।’

ওই কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা অনুসারী অংশের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। তার প্রতীক ছিল ঘোড়া।

সুদর্শনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমার অনুসারী অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের গত মেয়াদের চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা ভোটের সকালেই জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে তার প্রতীক ছিল দোয়াত কলম।

ইয়াসমিন জানান, ফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা প্রায় ২৫ জন গাদাগাদি করে একটি চাঁদের গাড়িতে উঠে রওনা হন বাঘাইছড়ির উদ্দেশে। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ছাড়াও পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা ছিলেন ওই গাড়িতে।

তাদের গাড়ি যখন বাঘাইহাট পৌঁছায়, তখন সেখানে অপেক্ষা করছিল আরো দুটো চাঁদের গাড়ি। সাজেক ইউনিয়নের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শেষে ভোটগ্রহণকর্মীরা ওই দুটি গাড়িতে করে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন।

ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের তিনটি গাড়ি তখন একসঙ্গে বাঘাইছড়ির দিকে রওনা করল। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বিজিবির একটা টহল গাড়ি। চারটি গাড়ির বহর, সবার সামনে বিজিবির গাড়ি। তার পেছনেই ছিল আমাদের গাড়িগুলো। নয়মাইল এলাকায় পৌঁছানোমাত্র পাশের উঁচু পাহাড় থেকে পেছনের তিনটি গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়। কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো থামেনি। গুলি উপেক্ষা করে চালকরা গাড়ি টেনে চালিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। এ এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। কান্না, চিৎকার, রক্ত...।’

রক্তাক্ত চাঁদের গাড়ি থেকে নামানোর পর একে একে  ছয়জনের মৃত্যু হয় সেখানেই। রাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরো একজন।

নিহতরা হলেন পোলিং অফিসার আমির হোসেন ও আবু তৈয়ব, আনসার-ভিডিপি সদস্য মিহির দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম এবং মন্টু চাকমা।

‘সারা দিন আমরা একসঙ্গে কাজ করলাম, সেই মানুষগুলো একের পর এক...,’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়াসমিন আক্তার।

একটু সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে তিনি বলেন, ‘এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার সহকর্মী আমির হোসেন, তৈয়ব আলী মারা গেছে। আমার বান্ধবী কাঞ্চি, বড় ভাই বদিউজ্জামান, ওরা গুরুতর আহত। হতাহত সবাই তো আমার কমবেশি চেনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন তাদের মরতে হলো? কবে বন্ধ হবে এসব বর্বরতা। আর কত লাশ পড়বে পাহাড়ে? এর মধ্যে কীভাবে আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করব?’

প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইয়াসমিন বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন কিংবা যেকোনো সরকারি দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই কঠিন। আমাদের নানা ধরনের চাপে থাকতেই হয়। কিন্তু এরকম ভয়াবহ বর্বরতা ভবিষ্যতে আমাদের আরো বেশি চাপে ফেলবে। আমি অনুরোধ করি, আপনি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।’ বিডিনিউজ

মামলা হয়নি, ময়নাতদন্তের অপেক্ষা

বাঘাইছড়ির ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি থানায়; পুলিশ কাউকে গ্রেফতারও করেনি।

বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিহত ছয়জনের লাশ গতকাল দুপুরে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়েছিল হাসপাতালের পরিবেশ।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছুফি উল্লাহ জানান, ময়নাতদন্ত করার জন্য মৃতদেহগুলো খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।

তিনি বলেন, ‘একের পর এক ঘটনায় আমরা বেশ চাপের মধ্যে আছি। এর মধ্যে বিলাইছড়িতে আজ (গতকাল মঙ্গলবার) আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। দুর্গম এলাকা আর বাস্তবতার কারণেই দ্রুত কিছু করা কঠিন হচ্ছে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads