• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ভালো কোম্পানির আইপিও বিড়ম্বনা

পুঁজিবাজার

সংরক্ষিত ছবি

পুঁজিবাজার

ভালো কোম্পানির আইপিও বিড়ম্বনা

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি

  • আলতাফ মাসুদ
  • প্রকাশিত ২৩ জুলাই ২০১৮

পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে অনেক দিন ধরেই দেশের সেরা কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নীতিনির্ধারকরা। এতে সাড়া দিয়ে ব্র্যান্ডভ্যালু রয়েছে এমন কিছু কোম্পানি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্তির আবেদনও জানিয়েছিল। তবে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণে এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সেগুলো।

জানা গেছে, ছয় বছর আগে আইপিওর আবেদন করেও তালিকাভুক্ত হতে পারেনি এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড। আবাসন খাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি নাভানা রিয়েল এস্টেট প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণে আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর বাইরে কয়েক বছর ধরে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অপেক্ষায় রয়েছে অন্তত ১০টি কোম্পানি। কিন্তু বিলম্বের কারণে ভালো কোম্পানিগুলো আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। যদিও স্থিরমূল্য মূল্য পদ্ধতিতে (ফিক্সড প্রাইস মেথড) বেশকিছু কোম্পানি তালিকাভুক্তির অনুমোদন পেয়েছে, যার একটি বড় অংশই নামপরিচয়সর্বস্ব ও দুর্বল মৌলভিত্তির।

প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও বিলম্বের কারণে গত আট বছরে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে মাত্র চারটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পেরেছে। একটি কোম্পানি রয়েছে অপেক্ষায়। সম্প্রতি আরো দুই কোম্পানি শেয়ারের প্রান্তসীমা নির্ধারণে নিলামের অনুমোদন পেয়েছে। যদিও স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে গত আট বছরে ৭৫ কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে পেরেছে।

বর্তমান কমিশনের আমলে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে অনুমোদন পাওয়া কিছু কোম্পানিকে ঘিরে। এর মধ্যে এমারল্ড অয়েল, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ফ্যামিলি টেক্স, সুহূদ ইন্ডাস্ট্রিজ অন্যতম। দুর্বল মৌলভিত্তির ও নামসর্বস্ব এমন কিছু কোম্পানিকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যারা আইপিওর পর লোকসানে পড়েছে। কয়েকটি কোম্পানির উৎপাদন কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। আবার এমন কোম্পানিও তালিকাভুক্ত হয়েছে, যার উদ্যোক্তারা আইপিও পরবর্তীতে খেলাপির দায়ে জেল খেটেছেন। ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে না পেরে বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

এদিকে স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে কয়েকটি কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের আপত্তি ছিল। ডিএসইর আপত্তি সত্ত্বেও গত ২৬ জুন আইপিওর অনুমোদন পায় একটি কোম্পানি। ওই কোম্পানির পণ্য বিক্রি ও উৎপাদন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে ডিএসইর রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আরএসি)। ২০১৭ সালের ৩০ জুন হিসাব বছরের পণ্য বিক্রি আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বাড়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কোম্পানির নিকট চেয়ে পাঠায় ডিএসই। তবে কোম্পানি ডিএসইকে তা সরবরাহ করতে পারেনি। এ অবস্থায় কোম্পানির পণ্য বিক্রিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রসপেক্টাসে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে সন্দেহ পোষণ করে আইপিও অনুমোদন না দিতে বিএসইসির নিকট পর্যবেক্ষণ পাঠায় ডিএসই। তবে ডিএসইর পর্যবেক্ষণ আমলে না নিয়েই কোম্পানির আইপিওতে সম্মতি দেয় বিএসইসি। ডিএসই সূত্র জানিয়েছে, এমন বেশ কিছু কোম্পানিকে আইপিওর অনুমোদনে ডিএসই আপত্তি দিলেও বিএসইসি তা আমলে নেয়নি।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমান বুক বিল্ডিং ব্যবস্থায় কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে চাইলে দেড় থেকে দুই বছর সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। যদিও ভারতে এ ক্ষেত্রে সময় লাগে মাত্র তিন মাস। ভারতে ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে কোম্পানিগুলো আইপিও অনুমোদনের আবেদন থেকে শুরু করে লেনদেনে চলে আসতে পারে। বাংলাদেশে লাগছে এর অন্তত ৬ গুণ বেশি সময়।

আইপিও পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১০ সালের ধসের পরিপ্রেক্ষিতে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি স্থগিত থাকায় ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে আইপিওর আবেদন জানায় এনার্জিপ্যাক। পরে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি চালু হওয়ায় ২০১৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এ পদ্ধতিতে রোড শো করে কোম্পানিটি। ২০১৪ সালে শেয়ার দর নির্ধারণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষের পর কোম্পানিটির আইপিও আবেদন বাতিল করে বিএসইসি। এরপর পদ্ধতিগত জটিলতা ও অস্বাভাবিক বিলম্ব এড়াতে প্রিমিয়ামসহ স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে আইপিওর আবেদন করে এনার্জিপ্যাক, যা ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি বিএসইসি অনুমোদন দেয়।

তবে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আইপিওর নতুন বিধিমালার যে গেজেট প্রকাশ হয়, তাতে প্রিমিয়াম চাইলে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আবেদনের কথা বলা হয়। সে অনুযায়ী আবেদন করায় আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হলেও কয়েক দিনের মধ্যে সেটি স্থগিত করে নতুন আইনে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুনরায় আবেদন জানাতে কোম্পানিটিকে চিঠি দেয় বিএসইসি। ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর কোম্পানিটি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আবারো রোড শো করলেও এখনো শেয়ার দর নির্ধারণে বিডিংয়ের অনুমতি পায়নি। ফলে প্রায় ছয় বছর ধরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে এনার্জিপ্যাক। শুধু এটিই নয়, ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইন সংস্কার হওয়ার পর অন্তত পাঁচটি কোম্পানিকে নতুন করে আইপিওর আবেদন করতে হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু রুলস), ২০১৫ কার্যকর হওয়ার পর যেসব কোম্পানি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত হতে রোড শো করেছে তাদের মধ্যে মাত্র দুটি অনুমোদন পেয়েছে।

২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল রোড শো করে এসটিএস হোল্ডিংস লিমিটেড। অ্যাপোলো হাসপাতালের মালিকানায় থাকা এ কোম্পানিটি এখনো শেয়ার দর নিলামের অনুমোদন পায়নি। ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল রোড শো করলেও উদ্যোক্তাদের মধ্যে কোন্দলের কারণে প্রক্রিয়াটি আটকে আছে। ডেল্টা হাসপাতাল লিমিটেড একই বছরের ৬ অক্টোবর রোড শো করে। প্রায় একই সময়ে রোড শো করে রানার অটোমোবাইলস ও ইনডেক্স অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

২০১৭ সালে পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস, এস্কোয়ার নিট কমপোজিট, শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেট ও লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড রোড শো করে। আর চলতি বছর বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার, স্টার সিরামিকস ও মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেড রোড শো করেছে। এর মধ্যে এস্কোয়ার নিট কমপোজিট ও রানার অটোমোবাইল শেয়ারদর নির্ধারণের অনুমতি পেলেও অন্য কোম্পানিগুলো নিলামের জন্য বিএসইসির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

২০১০ সালের ধসের পর বর্তমান কমিশন মোট চারটি কোম্পানিকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড হচ্ছে প্রথম কোম্পানি, যেটি বর্তমান কমিশনের আমলে অনুমোদন পেয়েছে। এ কোম্পানিটি ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল রোড শো এবং বিডিং প্রক্রিয়া শেষে ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শুরু করে। এক্ষেত্রে প্রায় দুই বছর লেগেছে। একমি ল্যাবরেটরিজের লেগেছে ১ বছর ৮ মাস। আমরা নেটওয়ার্কস দেড় বছর ও বসুন্ধরা পেপার মিলস এক বছরে তালিকাভুক্ত হতে পেরেছে। এর বাইরে ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই রোড শো করা আমান কটন ফাইবার্স সব প্রক্রিয়া শেষে লেনদেনের অপেক্ষায় রয়েছে।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওতে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ জানতে বিভিন্ন কোম্পানি ও ইস্যু ম্যানেজারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ মন্তব্য করতে চাননি। আইপিওর দায়িত্বে থাকা মার্চেন্ট ব্যাংকাররা বলছেন, এই দেরির জন্য কোম্পানিগুলোর তথ্যের স্বল্পতা কখনো কখনো দায়ী। আবার কখনো কখনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাও দেরি করে। বিএসইসির অনুমোদন কার্যক্রমেও ধীরগতি রয়েছে। তাছাড়া আগে আইপিও অনুমোদনের আবেদন করার ২৮ দিনের মধ্যে বিএসইসির পক্ষ থেকে কোয়ারি (কোম্পানির দেওয়া তথ্যের বাইরে অতিরিক্ত যা লাগবে এ ব্যাপারে কোম্পানিকে জানানো) দেওয়া হতো। এখন বুক বিল্ডিং আইনে কোয়ারি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা দেওয়া নেই। ফলে সময় আরো বেশি লেগে যাচ্ছে। আবার সবকিছু ঠিক থাকলেও বাজার পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বিলম্ব ঘটানোর অভিযোগও করেন তারা।

২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের পর সরাসরি ও বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্তি নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে এমআই সিমেন্ট ও এমজেএল বাংলাদেশ ২০১০ সালে এ পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহ করলেও তালিকাভুক্তির অনুমোদন আটকে যায়। পরে ২০১১ সালে নির্ধারিত শেয়ার দর কমিয়ে ও লেনদেন শুরুর পরবর্তী ছয় মাসে শেয়ার দর বরাদ্দ মূল্যের নিচে নামবে না, এমন নিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় তালিকাভুক্তির অনুমোদন পায়। এ দুই কোম্পানি বিএসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকারের নেতৃত্বে থাকা কমিশনের অনুমোদনে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। পরে তালিকাভুক্তি আটকে গেলে শর্তসাপেক্ষে বর্তমান কমিশন স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের অনুমোদন দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারতের আইপিও প্রক্রিয়া পুরোপুরি মার্কেট বেজড, আর আমাদের এখানে বিএসইসি এখনো আইপিওর সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে অনুমোদন দেয়। ফলে এখানে কিছুটা সময় লাগে। তাছাড়া আমাদের এখানে আইপিও অনুমোদনের পরও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে ৩-৪ মাস সময় লেগে যায়। অথচ ভারতে এটি ৬ দিনের মধ্যেই হয়ে যায়।

এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আইপিওর অনুমোদন বিলম্বিত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আইন সংশোধন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন হওয়ায় প্রিমিয়াম চাওয়া কোম্পানিগুলোকে পুনরায় আবেদন করতে হয়। এ ছাড়া কোম্পানিগুলো যে প্রসপেক্টাস জমা দেয়, তা পর্যালোচনা করে বিএসইসি বিভিন্ন বিষয়ে যে ব্যাখ্যা চায়, তার জবাব কোম্পানিগুলো দ্রুত দিতে পারে না। এটিও আইপিও বিলম্বিত হওয়ার বড় কারণ।   

বাজার-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুঁজিবাজারের স্বার্থে ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হবে। আর ভালো কোম্পানিগুলো উপযুক্ত প্রিমিয়াম পাওয়ার জন্য বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতেই বাজারে আসবে। তাই এ প্রক্রিয়া যতটা সম্ভব দ্রুততর করা দরকার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads