• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
আইপিও অনুমোদনের ক্ষমতা চায় ডিএসই, বিশেষজ্ঞের না

ছবি : সংগৃহীত

পুঁজিবাজার

আইপিও অনুমোদনের ক্ষমতা চায় ডিএসই, বিশেষজ্ঞের না

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২০ মে ২০১৯

পুঁজিবাজারে কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদনের প্রাথমিক ক্ষমতা চায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত বন্ধ করতে এ উদ্যোগ নিয়ে শিগগিরই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) এ প্রস্তাব দেবে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তবে এর বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, আইপিও অনুমোদনের ক্ষমতা ডিএসইর হাতে দেওয়া ঠিক হবে না। বরং আইপিও অনুমোদনের আগে ডিএসইর মতামত নেওয়া যেতে পারে, যে নিয়ম এখনো বলবৎ রয়েছে। তবে অভিযোগ আছে, স্টক এক্সচেঞ্জের মতামত নিয়ন্ত্রক সংস্থা গুরুত্বসহকারে নেয় না। এটি বন্ধ করতে হবে এবং আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের যুক্তিসঙ্গত মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

ডিএসইর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরেজমিন পরিদর্শন না করে ডিসক্লোজার বেসিস অর্থাৎ প্রসপেক্টাস দেখে আইপিও অনুমোদন দেওয়ায় কয়েক বছর ধরে একের পর এক দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কয়েক বছর যেতে না যেতেই একাধিক কোম্পানির অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ায় সার্বিকভাবে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ কারণে ডিএসই থেকে ডিসক্লোজার বেসিসে আর কোনো আইপিও না দেওয়ার আবেদন করা হবে। সেই সঙ্গে আইপিও’র প্রাথমিক অনুমোদন ডিএসই থেকে নিতে হবে- এমন বিধান করার আবেদন জানানো হবে। এক্ষেত্রে যদি কোনো কোম্পানি আইপিওতে আসার আবেদন করে তাহলে ডিএসই থেকে প্রথমে ওই কোম্পানিটি সরেজমিন পরিদর্শন করা হবে। ডিএসই অনুমোদন দিলে কেবল বিএসইসি সেটিকে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আইপিও অনুমোদন দেবে।

প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে ডিএসই কোম্পানি সরেজমিন পরিদর্শনের পাশাপাশি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন অডিট করবে। প্রয়োজন হলে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) অথবা ভিন্ন কোনো অডিট ফার্মকে দিয়ে অডিট করানো হবে। এরপরও সন্দেহ থাকলে অধিকতর অডিটের ব্যবস্থা করা হবে।

ডিএসইর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্বের কোথাও পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরাসরি কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয় না। কোন কোম্পানি আইপিও-তে আসার যোগ্য তা নির্ধারণ করে স্টক এক্সচেঞ্জ। স্টক এক্সচেঞ্জ প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার পর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু বাংলাদেশে আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের কোনো ভূমিকা নেই।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, তুং হাই নিটিং, আরএন স্পিনিং, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ব্যবসায়িক কর্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে তুং হাই নিটিং এবং সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের কার্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে ডিএসইর পরিদর্শক দল ঢুকতেই পারেননি। কোম্পানি দুটির অফিস বন্ধ পায় ডিএসইর পরিদর্শক দল।

জানা গেছে, পারিবারিক অন্তঃকলহে বন্ধ হয়ে গেছে তুং হাই নিটিং ও সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ব্যবসা। আর বেসিক ব্যাংকের ঋণ জটিলতায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের। পর্ষদের অন্তঃকলহে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের। আরএন স্পিনিংয়ের উৎপাদনও সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ থাকা এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বসুন্ধরা পেপার, আমান কটন ফাইবার্স, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, অ্যাপোলো ইস্পাত, ওরিয়ন ফার্মা, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, রিজেন্ট টেক্সটাইল, জিবিবি পাওয়ার, বারাকা পাওয়ার, জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এমআই সিমেন্ট, আরগন ডেনিমস ও হামিদ ফেব্রিকস লিমিটেডের শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে।

ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের এক সদস্য বলেন, সম্প্রতি যেভাবে একের পর এক দুর্বল কোম্পানি অনুমোদন দেয়া হয়েছে, তা বাজারে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফার চিত্র তুলে ধরছে। কিন্তু তালিকাভুক্ত হওয়ার পরপরই ব্যবসায় মন্দা দেখা যাচ্ছে। এমনকি তালিকাভুক্তির মাত্র তিন বছরে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমন দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্তি হওয়া বন্ধ করতে হবে।

এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, আইপিও দেখার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে স্টক এক্সচেঞ্জের হাতে থাকা উচিত। স্টক এক্সচেঞ্জ আইপিও যাচাই-বাছাই করে তা অনুমোদনের জন্য সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা) কাছে পাঠাবে। যদি সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন এ কাজ করে তাহলে বিচার করবে কে?

তিনি বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিসক্লোজার বেসিসে কোনো আইপিও অনুমোদন করা উচিত নয়। আমাদের সবার কম-বেশি ছয়-নয় করার অভ্যাস আছে। এটা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের উচিত হবে তারা (কোম্পানি) যে অডিট রিপোর্ট দেবে, ব্যালেন্স শিট দেবে তার সবকিছু খতিয়ে দেখা এবং কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন করা।

আর্থিক প্রতিবেদন নিখুঁতভাবে নিরীক্ষা করা এবং কোম্পানি সরেজমিন পরিদর্শন করার সক্ষমতা ডিএসইর আছে কি- এমন প্রশ্ন করা হলে রকিবুর রহমান বলেন, ডিএসইর এ সক্ষমতা অবশ্যই আছে। এটা কোনো ব্যাপারই না। দরকার হলে কয়েকজন সেরা অডিটর দিয়ে প্যানেল করা হবে। প্রয়োজন হলে কার্যক্রম তদারকির জন্য আউটসোর্সিং করা হবে। এটা করা হলে নয়-ছয় করার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে এবং ভালো কোম্পানির আইপিও আসবে।

ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, সাধারণ নিয়ম হলো যখন একজন পাবলিক অফারিংয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন সে তালিকাভুক্তির নিয়ম অনুযায়ী স্টক এক্সচেঞ্জে আবেদন করবে। আর স্টক এক্সচেঞ্জ দেখবে তালিকাভুক্তির নিয়ম অনুযায়ী তার যে যোগ্যতা আছে কি-না? যদি তালিকাভুক্তির যোগ্য হয়, তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জ তা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে পাঠাবে। বিশ্বের সব জায়গায় এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়।

তিনি বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে এখন বলা হচ্ছে, অনেক কোম্পানি আসছে যারা আসলে তালিকাভুক্তির যোগ্যতা রাখে না। আমি মনে করি, যদি কোনো কোম্পানি আইপিওতে আসতে চায়, তাহলে সে আগে তালিকাভুক্তির আবেদন করবে এবং ডিএসই তালিকাভুক্তির যোগ্য মনে করলে বিএসইসিতে পাঠাবে। তালিকাভুক্তির যোগ্য হলেই যে বিএসইসি তাকে টাকা তোলার অনুমোদন দিয়ে দেবে তা কিন্তু নয়। সুতরাং আমি মনে করি, এটাই যুক্তিযুক্ত পদ্ধতি। আমরা বহু আগেই এ প্রস্তাব দিয়েছি। এটা বাস্তবায়ন হলে বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যকার দূরত্ব কমে আসবে।

সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আইপিও’র ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্র্যাক্টিস হচ্ছে ডিসক্লোজারস বেসিস। যদি কেউ মিথ্যা ডিসক্লোজার দেয়, তার বিরুদ্ধে যদি দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে এটা বন্ধ হবে। সবক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শন করতে গেলে অনেক সময়ের ব্যাপার। এমনিই আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার একটি অভিযোগ আছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ উপদেষ্টা বলেন, আইপিও অনুমোদনের ক্ষমতা ডিএসইকে দেওয়া উচিত হবে না। ডিএসই নির্ভরশীল হয়ে পড়লে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমি যখন বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলাম, সে সময় ডিএসই থেকে একটি কোম্পানির আইপিও অনুমোদন না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তখন ডিএসইর সুপারিশ উপেক্ষা করে ওই কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়া হয় এবং কোম্পানিটি এখনও বেশ ভালো করছে। সুতরাং ডিএসইর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হয়ে তাদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। এখনো আইপিও অনুমোদনের জন্য ডিএসইর মতামত নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads