• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি: বাংলাদেশের খবর

যোগাযোগ

সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল

৫০ লাখের বেশি চালক অবৈধ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০১৮

রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়ক এখন বেপরোয়া যান ও অদক্ষ চালকের দখলে। বেসরকারি পরিসংখ্যানে সারা দেশে যানবাহনের চালকের সংখ্যা ৭০ লাখ। এর মধ্যে বিআরটিএ’র লাইসেন্স আছে ২০ লাখেরও কম। অবশিষ্ট ৫০ লক্ষাধিক অবৈধ ও অদক্ষ চালকই সড়কে নৈরাজ্যের মূল কারণ। ফলে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য-দুর্ঘটনা। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া অবৈধ চালকদের কারণে দেশের ১৬ কোটির বেশি মানুষ আজ অনিরাপদ। খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও সম্প্রতি তার অসহায়ত্ব অকপটে স্বীকার করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় দুই বাসের প্রতিযোগিতায় রাজীবের কাটা হাতের ছবি এখন দেশের সড়ক পরিবহনের বাস্তব অবস্থার প্রতীক। শুধু রাজীব নয়, বাসচালকদের প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতার বলি রোজিনা, আয়শা, শিশু সুমি। এ তালিকায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে কঠোর আইনের আওতায় আনার পরামর্শ তাদের।  

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য মতে দেশে এই মুহূর্তে চলাচল করা বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলারসহ মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৭৯। এর বিপরীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছে প্রায় ২০ লাখ। আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে বাংলাদেশে ট্রাক-বাস-মিনিবাসসহ যানবাহন চলছে ৪০ লাখের ওপরে। তাদের বক্তব্য, মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনিবন্ধিত গাড়ির হিসাব দেশের কোনো সংস্থার কাছেই নেই। ৪০ লক্ষাধিক যানবাহন রাস্তায় চালাতে প্রতিটি গাড়ির জন্য একাধিক চালক প্রয়োজন। সাদা চোখে হিসাব করলে এসব যানবাহন চালাতে সঙ্গে কমপক্ষে ৮০ লাখ চালক প্রয়োজন। সেখানে বৈধ চালক আছে ২০ লাখ। এর মধ্যে অনেকেই মারা গেছে। আবার অনেকে এখন আর গাড়ি চালায় না। তাহলে বাকি সাড়ে ১১ লাখ গাড়ি কারা চালায়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় অনেক গাড়িই চালাচ্ছে হেলপাররা। যাদের বেশিরভাগের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। অথচ আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে একজন পেশাদার চালকের বয়স হতে হয় কমপক্ষে ২০ বছর। যার কোনোটি না থাকা সত্ত্বেও গাড়িভর্তি যাত্রী নিয়ে চলছে কিশোর চালকরা। লেগুনাগুলো কিশোর চালকরা চালিয়ে যাত্রীদের নিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব চালক জানায়, পুলিশকে টাকা দিলেই লাইসেন্স ছাড়া রাস্তায় গাড়ি চালানোর অনুমতি পাওয়া যায়।

এ ছাড়া দূরপাল্লার গাড়িগুলোর ১ শতাংশ বিআরটিসি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিমালিকানায় রয়েছে ৯৯ শতাংশ, যা নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি মালিকপক্ষ। একজন চালক দিনে বা রাতে কত ঘণ্টা ড্রাইভ করবে বা কতটুকু দূরত্ব পর্যন্ত ড্রাইভ করবে তাও সরকার নির্ধারণ করেনি। ফলে চালক নিজের শরীরের ওপর যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।

এদিকে বিআরটিএ’র এই হিসাব মানতে নারাজ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিআরটিএ শুধু কাগজের হিসাব থেকে তথ্য প্রকাশ করছে। বাস্তবে বৈধ-অবৈধ গাড়ি মিলিয়ে সারা দেশে ৪০ লাখের বেশি গাড়ির পেছনে নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে চালক রয়েছে ৭০ লাখ। তাদের মধ্যে বিআরটিএ’র লাইসেন্স আছে সর্বোচ্চ ১৮ লাখের। বাকিরা অবৈধভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। তাদের বক্তব্য, বিআরটিএ যে ২০ লাখ লাইসেন্সধারী চালকের কথা বলছে তাদের অনেকেই মারা গেছে, আবার কেউ কেউ গাড়ি চালায় না।

অবৈধ গাড়ি বলতে মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ (নিবন্ধন বাতিল) ও অননুমোদিত বাস, লেগুনা, নসিমন-করিমন ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়ি সারা দেশে যাত্রী পরিবহন করছে। এই চালকদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই।

এদিকে ঢাকার বাস ও হিউম্যান হলার চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবহন মালিকদের চাপেই তাদের বেপরোয়া গাড়ি চালাতে হয়। কারণ যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে বেতনও দেন না মালিকরা। এ ছাড়া চালকের লাইসেন্স আছে কি না, গাড়ি দেওয়ার সময় তা দেখেন না মালিকরা।

অন্যদিকে মালিকরা দায় চাপান চালকদের ওপর। তারা বলেন, গাড়ি নিয়ম মেনেই পরিচালনা করতে দেওয়া হয় চালকদের। বেপরোয়াভাবে বাস চালালে জরিমানাসহ চালকের কঠোর শাস্তি চান পরিবহন মালিকরা।

পরিবহন মালিক মিজানুর রহমান বলেন, বেতনভুক্ত চালক দিয়ে লোকাল (বাস) গাড়ি চালালে মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নগরীর অধিকাংশ পরিবহন মালিক তাদের বাস-মিনিবাস চালককে চুক্তিতে চালাতে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো মালিকই চালকের লাইসেন্স দেখে না। তাছাড়া লাইসেন্স থাকলেও চালকরা চাঁদা ছাড়া গাড়ি চালাতে পারে না। রাস্তায় নামলে প্রতিদিন একটি গাড়িকে ৭শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন চাঁদা দিতে হয়। চুক্তি ও চাঁদার কারণেই চালকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে সড়কে। কারণ একই রুটের যে বাস আগে শেষ গন্তব্যে পৌঁছবে সে-ই ফিরতি ট্রিপের সিরিয়াল পাবে আগে। এ কারণে একই রুটের বাসের মধ্যেই ভয়াবহ প্রতিযোগিতা দেখা যায়। আর এই প্রতিযোগিতার কারণেই প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আমিন নুরু বলেন, অনেক চালকের বৈধ লাইসেন্স না থাকায় সংগঠনের পক্ষ থেকে অনেকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তাছাড়া চালকের সিংহভাগই অল্প শিক্ষিত। লাইসেন্সপ্রাপ্তির বিষয়টি জটিল। এ কারণে লাইসেন্স নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অনেকে নিতে পারে না। সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোর জন্য সব সময় সচেতন করা হচ্ছে।

অপরদিকে বাংলাদেশ ট্রাক কভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতা হোসেন আহম্মেদ মজুমদার বলেন, সড়কে এসব মর্মান্তিক ঘটনা থেকে রেহাই পেতে চালকদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি যাত্রী ও পথচারীদেরও সতর্ক হতে হবে। তা না হলে কোনো অবস্থায়ই দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না।

বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সংস্থা থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু এর সফলতা পেতে ট্রাফিক পুলিশকে আরো কঠোর হতে হবে। নইলে বিআরটিএ’র বিদ্যমান জনবল দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। 

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) রেজাউল করিম বলেন, গাড়ি নিয়ে চালকদের অসম প্রতিযোগিতার পেছনে অনেক সমস্যা আছে। গাড়ির মালিকদের মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান দরকার। কোনো অবস্থায় অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ি ছাড়া যাবে না। তাছাড়া পথিমধ্যে বাসে যাত্রী ওঠানো-নামানো হয়ে থাকে। এটি বন্ধ হওয়া দরকার। আইনের সঠিক প্রয়োগে ট্রাফিক পুলিশকে ইতোমধ্যে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে আইনের পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী ও যাত্রীদেরও আরো দায়িত্বশীল হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

পরিবহন সেক্টরে সংশ্লিষ্টদের মানসম্পন্ন তদারকি নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অদক্ষ চালকের কারণেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। পেশাদার চালক, যাদের ওপর যাত্রীদের জানমালের নিরাপত্তা নির্ভর করে তাদের শারীরিক ফিটনেস জরুরি। কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষিত করে এ দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ঢাকা শহরে যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করে সত্যিকারে সে পরিমাণ ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক নেই। ফলে অদক্ষ চালক ও শ্রমিকের কারণে এখন পরিবহনে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। সমিতির পক্ষ থেকে ভিজিল্যান্স টিম গঠন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads