• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ঢাকার পরিবহনে নৈরাজ্য

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় যানবাহন চালক ও পথচারীরা কিছুটা শৃঙ্খলার মধ্যে এলেও এখন আবার ফিরে গেছে নিয়ম লঙ্ঘনের পুরনো ফর্মে। রাজধানীর বাংলামোটরের দৃশ্য

ছবি : -আদনান আদিদ

যোগাযোগ

ঢাকার পরিবহনে নৈরাজ্য

দুই-তৃতীয়াংশ বাসের নেই রুট পারমিট, অর্ধেক চালকেরই নেই বৈধ লাইসেন্স

  • রানা হানিফ
  • প্রকাশিত ১০ আগস্ট ২০১৮

চালকের বৈধ লাইসেন্স এবং যানবাহনের নিবন্ধন ও রুট অনুমোদন না থাকায় চলমান ট্রাফিক সপ্তাহে রাজধানীসহ সারা দেশে তীব্র পরিবহন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পরপরই এ সপ্তাহ শুরু হওয়ায় মামলার আতঙ্কে অনেক মালিকই বাস নামাচ্ছেন না রাস্তায়। আর রুট পারমিট ও নিবন্ধন থাকার পরও চালক সঙ্কটে বন্ধ রয়েছে অনেক বাসের চলাচল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর অনুমোদিত বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন কোম্পানির নামে চলাচলকারী বাসের দুই-তৃতীয়াংশেরই রুট পারমিট নেই। আর দীর্ঘদিন ধরে চলা এই অরাজকতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার জেরেই পরিবহন খাতের এই ভগ্নদশা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন কার্যত শেষ হলেও পরিবহন খাতের নৈরাজ্য যেন শেষ হওয়ার নয়। গণপরিবহন রাস্তায় কম নামায় অটোরিকশা, রিকশাচালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যা ইচ্ছে ভাড়া হাঁকছে তারা। ফলে অসহায় মানুষ মাইলের পর মাইল হাঁটছেন তীব্র গরমের মধ্যে। পরিবহন সঙ্কটের এই চিত্র দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করছে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্দোলন শেষ হওয়ার মধ্যেই সারা দেশে ট্রাফিক সপ্তাহ উদযাপন শুরু হওয়ায় এই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে সড়ক, মহাসড়কে পুলিশের কঠোর অবস্থানের নামে হয়রানি বেড়ে গেছে। কারণে-অকারণে মামলা দেওয়ায় আতঙ্কে রাস্তায় গাড়ি নামাচ্ছেন না পরিবহন মালিকরা।

তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ট্রাফিক বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের গণপরিবহন খাতের দীর্ঘদিনের নৈরাজ্য ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কারণেই এমন সঙ্কট। আইনের প্রয়োগ একটু কঠোর হতেই ধসে পড়েছে খাতটি।

বাস সঙ্কটে গতকাল বৃহস্পতিবারও চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসীকে। স্টপেজগুলোতে দাঁড়িয়ে থাকলেও ছেড়ে যায়নি অনেক বাসই। ফলে কর্মমুখী নগরবাসীর সীমাহীন ভোগান্তির পাশাপাশি বেড়েছে হয়রানিও। বাস সঙ্কটে বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা ও রাইড শেয়ারিং পরিবহন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। আর এই সুযোগে দুই থেকে তিনগুণ ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া ও নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে অস্বীকৃতির মতো যাত্রী হয়রানিতেও মেতে ওঠে বিকল্প পরিবহনের চালকরা।

বৃহস্পতিবার সারা দিন রাজধানীতে পরিবহন সঙ্কট ছিল ভয়াবহ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস ছুটি হতে থাকায় বেলা ৩টা থেকে সঙ্কট আরো বাড়তে থাকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকেছে হাজার হাজার সাধারণ যাত্রী। দীর্ঘ বিরতিতে দু-একটি বাস দেখা গেলেও তাতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। অনেকেই তিনগুণ ভাড়ায় চড়েছেন রিকশায়। অপেক্ষমাণ যাত্রীর তুলনায় সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা ছিল সীমিত। চালকরা মিটারের নির্ধারিত ভাড়ায় যেতে রাজি হয়নি। নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কট দেখা দেয় রাইড শেয়ারিং পরিবহন ব্যবস্থায়ও।

বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় আরামবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বাসস্টপেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী হেঁটেই বাড়ি ফিরেছে। কথা হয় নটর ডেম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মুশফিকুর রহমান অনিকের সঙ্গে। অনিক বলেন, দেড় ঘণ্টা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম। পরে হেঁটেই বাসায় (খিলগাঁও) যাচ্ছি।

বিকাল ৫টায় এই চিত্র আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। অফিসপাড়া মতিঝিলে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা জনসমুদ্রে রূপ নিতে থাকে। বিআরটিসির বাসে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে কর্মজীবী নারীদের।

মতিঝিলের একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মেহের নিগার মালা জানান, ছুটির পর অফিস থেকে আজিমপুরের বাসায় ফেরার জন্য বাস পেতে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, বাস না পেয়ে দু-একটা সিএনজি যাও পেয়েছি তাও যেতে রাজি হয়নি। এক সিএনজি অটোরিকশাচালক ৫০০ টাকা ভাড়া চেয়ে বসে। রিকশাচালকরাও দ্বিগুণ ভাড়া চাইছে।

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম এমিল বলেন, আগে যেখানে প্রতি মিনিটে একটা করে বাস পেতাম, এই কয়েক দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও মতিঝিল থেকে মহাখালীর বাস পাইনি। আজ (বৃহস্পতিবার) তো আরো অবস্থা খারাপ। একসঙ্গে চারটা রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে রিকোয়েস্ট দিয়েছি, কোনো রাইডার রিসিভ করছে না। দুজন রিসিভ করলেও কমিশন (ছাড়) আছে জেনে রিকোয়েস্ট কেটে দিয়েছে।

গণপরিবহনের এমন সঙ্কটের সময় কমলাপুর থেকে আরামবাগ সড়কের দুই পাশে সারি সারি বাস পার্ক করে রাখতে দেখা যায়। একই ভাবে মতিঝিলে মিরপুর রুটের বিভিন্ন কোম্পানির শতাধিক বাস দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো যাত্রী তোলেনি।

হঠাৎ এই সঙ্কটের কারণ জানতে চাইলে বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে রাস্তায় পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। আন্দোলনের পরপর ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হওয়ায় অনেক মালিকই মামলার ভয়ে রাস্তায় গাড়ি বের করছেন না। আবার মালিক চাইলেও চালক রাজি হচ্ছেন না। আশা করছি আগামী সপ্তাহ থেকেই পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে।

তবে মালিকদের একটি পক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। মতিঝিল টু সাভার রুটের ওয়েলকাম পরিবহনের একজন মালিক মো. সাদেকুল ইসলাম। এই রুটে তার তিনটি বাস চলে। তিনি বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় অনেক চালক বাস চালাতে রাজি হচ্ছেন না। আবার একই কোম্পানির কয়েকশ বাস থাকলেও দেখা যাবে তিন ভাগের এক ভাগেরও নেই রুট পারমিট।

সাদেকুলের এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের এক গবেষণায়। তাতে দেখা গেছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে ২৮৯টি বাস ও মিনিবাসের রুট অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। এসব রুটের বিপরীতে সর্বোচ্চ বাসের সংখ্যা (সিলিং) ছিল ১২ হাজার ৫২৬টি। ঠিক একই সময় পর্যন্ত রাজধানীতে ২৭ হাজার ৫৩৭ বাস, ১০ হাজার ২১৪টি মিনিবাসসহ মোট ৩৭ হাজার ৭৫১টি বাস-মিনিবাসকে নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ। ওই হিসাবে ২০১৬ সালেই রাজধানীতে ২৫ হাজার ২২৫টি বাসের বৈধ নিবন্ধন থাকলেও ছিল না বৈধ রুট পারমিট। তবে বিআরটিএ বলছে রাজধানীতে নিবন্ধন নিলেও সব বাসই ঢাকায় চলাচল করে না। বেশ কিছু বাস রাজধানীর নিবন্ধনে দূরপাল্লা ও অন্যান্য জেলায়ও চলাচল করছে।

রাজধানীতে বৈধ নিবন্ধন না নেওয়া ও রুট পারমিটবিহীন বাসের প্রকৃত সংখ্যাও নেই সরকারের এই সংস্থার কাছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মোসলেহ উদ্দিন হাসান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ঢাকায় নিবন্ধন নেওয়া বাস দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে এটা সত্য। তবে সেই সংখ্যাটা কত? মোট নিবন্ধিত সংখ্যার অর্ধেকও হবে না। এ ছাড়া রুট পারমিট ও বৈধ নিবন্ধন নেই এমন বাসের সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য নেই কারো কাছে। সে হিসেবে এটা বলা যায়, রাজধানীতে বিভিন্ন কোম্পানির নামে যে বাস চলছে তার তিন ভাগের দুই ভাগেরই রুট পারমিট নেই। আর সরকারি হিসাব অনুযায়ীই তো আমরা জেনেছি নিবন্ধিত গাড়ির অর্ধেক চালক লাইসেন্সধারী। এই যখন চিত্র তখন আইনের সামান্য কঠোর অবস্থানে এমন ভয়াবহ অবস্থা তো হবেই। পরিবহন খাতে এই নৈরাজ্য একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের চলা অরাজকতা, দুর্নীতি, অনিয়মের ফলেই এই দশা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads