• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
পরিবহন ‘মাফিয়াদের’ কাছে জিম্মি নগরবাসী

নগরবাসীর দুর্ভোগের আরেক নাম ‘নগর পরিবহন’

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

পরিবহন ‘মাফিয়াদের’ কাছে জিম্মি নগরবাসী

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিভিন্ন সূচকে দেশবাসীর জীবনযাত্রার মান বাড়লেও নগর জীবনে নানা দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার যেন কমতি নেই। নগরবাসীর নানা দুর্ভোগের একটির নাম ‘নগর পরিবহন’। দেশের বিভিন্ন নগরীতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ বাড়লেও নগর পরিবহনে বাড়েনি সেবার মান। বছরের পর বছর ধরে চলছে নগর পরিবহনের এই নৈরাজ্য। বাড়তি ভাড়া আর সেবার নামে প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন সড়কে চলাচলের অযোগ্য এসব গাড়ির মালিকরা। কিন্তু দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে না যাত্রীরা। দেশের অন্যান্য নগরীর চেয়ে রাজধানী ঢাকার যাত্রীদেরই বেশি বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। প্রতিদিন যাত্রী আর পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। এসব ঘটনা কখনো কখনো বড় নৃশংসতায় রূপ নিতেও দেখা গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা বার বার পদক্ষেপ নিয়েও কোথায় যেন থমকে যান।

রাজধানী ঢাকার কোটি মানুষের ভিড়কে পুঁজি করে গড়ে ওঠা বিশাল এই পরিবহন সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে এখানকার বাসিন্দারা। এদের নেপথ্য শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে সরকারের ভেতরে-বাইরে থাকা পরিবহন মাফিয়াদের একটি চক্র। বড় ঘটনা, দুর্ঘটনা, আইন-আদালত আর ঝক্কি মোকাবিলায় পরিবহন মালিকদের এ চক্রটিই নানাভাবে সহায়তা করে থাকে। যার বিনিময়ে মোটা দাগের স্বার্থ হাসিল করে তারা। এই চক্রের কারো কারো রয়েছে পরিবহন ব্যবসাও। এদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কথা বলার সাহস কারোরই নেই।

এদিকে ঢাকার নগর পরিবহনে সিটিং সার্ভিসের নামে যেমন চলছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় তেমনি যাত্রীদের বসার আসনটিতেও মিলছে না স্বস্তি। বেশিরভাগ বাসেই দুই সিটের আসনকে করা হয়েছে তিন সিটের। আবার ১৯৮২-৮৪ সালের শত শত ভাঙাচোরা মিনিবাস এখনো চলছে রাজধানীর রাস্তায়। এসব বাসকে অনেক যাত্রী মান্দাতা আমলের ‘মুড়ির টিন’ বলে থাকেন। নগর পরিবহনের এসব বাস রাজধানীর সব রুটেই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলে। এসব গাড়ির চালকরাও বেপরোয়া। কোনো যাত্রী হাত তুললেই যেখানে সেখানে স্টপিজ। সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়েও যাত্রী ওঠানামা করতে দেখা যায়।

অন্যদিকে কিছু বাস সারাদিন ‘লোকাল’ হিসেবে চললেও অফিস সময়ে ‘সিটিং’ হয়ে যাচ্ছে। ফলে জরুরি সময়ে যানবাহন না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বাড়তি ভাড়া দিয়েও যেতে হয় দাঁড়িয়ে। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও সেবা পাচ্ছেন না যাত্রীরা।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার শহর ও শহরতলির আড়াই শ রুটে প্রায় আট হাজার বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। প্রতিটি রুটেই দেখা যায় যাত্রীদের এই ভোগান্তির চিত্র।

প্রগতি সরণি হয়ে চলাচলকারী অনাবিল, সালসাবিল, সুপ্রভাত, রাইদা, ভিক্টর, প্রচেষ্টা, তুরাগসহ প্রায় পরিবহনের বাসই হয়ে গেছে ‘সিটিং সার্ভিস’। বলাকা পরিবহনের তিনশ বাসের মধ্যে কিছু লোকাল, কিছু সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করত। কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর থেকে সব গাড়িই ‘সিটিং’ হিসেবে চলছে।

আবার সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, মতিঝিল ও সদরঘাট থেকে মহাখালী হয়ে বিমানবন্দর, আব্দুল্লাহপুর, গাজীপুরের বিভিন্ন রুটে চলে কয়েকটি পরিবহনের বাস। সায়েদাবাদ থেকে বলাকা, সদরঘাট থেকে আজমেরী, স্কাইলাইন, গুলিস্তান থেকে প্রভাতী-বনশ্রী, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ-এয়ারপোর্ট পরিবহন লিমিটেড, গুলিস্তান-গাজীপুর পরিবহন এবং মতিঝিল থেকে গাজীপুর পরিবহন এবং আল মক্কা পরিবহনের বাস চলাচল করে।

গুলিস্তান-গাজীপুর পরিবহনের বাস এমনিতে ‘লোকাল’ হিসেবে যাত্রী নিলেও অফিস ছুটির সময় এ পরিবহনের বাসগুলোও ‘সিটিং সার্ভিস’ হয়ে যাচ্ছে। মহাখালীর গার্মেন্ট কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, অফিস শেষে প্রায় প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আবার বাসে উঠতে পারলেও কন্ডাক্টররা মালিকের দোহাই দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। এটা যাত্রীদের ‘পকেট কাটার’ মতো। তিনি আরও বলেন, পরিবহনে নৈরাজ্য কমাতে সরকার নতুন নতুন আইন করলেও পরিবহন ‘মাফিয়াদের’ লাগাম টেনে ধরতে পারছে না।

নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড ও সাইনবোর্ড থেকে যাত্রাবাড়ী, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে চলাচলকারী ঠিকানা, মৌমিতা, নীলাচল, লাব্বাইক, রজনীগন্ধা, মনজিল, অনাবিলসহ সব পরিবহনের বাস ‘সিটিং সার্ভিস’ হয়ে গেছে।

যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মাহাবুব বলেন, ‘এরা সিটিং নাম নেয় শুধু বেশি ভাড়া নেওয়ার জন্য। সবাই ঠেসে ঠেসে যাত্রী নেয়। শুধু দু-একটা পরিবহন একটু রেহাই দেয়।’ আজিমপুর থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী উইনার, বিকাশ, ভিআইপি,  মিরপুর মেট্রো সার্ভিস, মিরপুর লিংক, বিহঙ্গ, আশীর্বাদ, সেফটি, দেওয়ান, রমজান, বিকল্প পরিবহনসহ সব গাড়িই এখন ‘সিটিং সার্ভিস’ বলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।

কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট এলাকা থেকেও ঘরমুখো যাত্রীদের সঙ্কটে পড়তে হয় বলে জানালেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে সফিকুল আলম নেহাল। তিনি বলেন, ‘এই দুর্ভোগ আরো বাড়িয়েছে ‘সিটিং সার্ভিস’। গত এক-দেড় বছরে বেশিরভাগ বাস ‘সিটিং’ নাম নিয়ে নিয়েছে। গাড়িতে উঠতে গেলে ধাক্কা মারে, খারাপ আচরণ তো করেই।’

সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাড়তি ভাড়া নেওয়াসহ যাত্রী হয়রানির অভিযোগের কারণে বাস মালিকরা ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর সে বছর মে মাসে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযান শুরু করলে অনেক মালিক সড়কে বাস নামানো বন্ধ করে দেন। পরে আলোচনা সাপেক্ষে সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দেয় বিআরটিএ।

২০১৮ সালের মে মাসে ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি’ একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ঢাকার ২১টি রুটের এক হাজার ৫৩টি বাসের ওপর জরিপ চালায় তারা। এতে দেখা যায় ৯৬ শতাংশ গাড়িই ‘সিটিং সার্ভিস’ হিসেবে চলাচল করছে।

সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘দিন দিন পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। যাদের আইন প্রয়োগের অভাবেই পরিবহন মালিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস’ বিষয়টিই অনুমতিবিহীন’ যারা এটি করছেন তারা অন্যায় করছেন। এটি বন্ধে আমরা কমিটি করেছি, সুপারিশও করেছি। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সব সিটিং হয়ে গেলে সাধারণ যাত্রীদের কী হবে।’

নগরবাসীর অনেকেই বলেন, বাস মালিকদের এই স্বেচ্ছাচারিতা আর কতদিন চলবে। একটি দেশের রাজধানী এভাবে চলতে পারে না। শিগগির এর একটা বিহিত করা দরকার। নইলে জনরোষ থেকে যে কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads