• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

যোগাযোগ

সড়ক শৃঙ্খলায় পুলিশের ২১ সুপারিশ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০১৯

চালকদের বেপরোয়া মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া এবং পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না।

একের পর এক ট্রাফিক সপ্তাহ, টাস্কফোর্সের কার্যক্রম হলেও কার্যত তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়কে আগের চেয়ে পুলিশি তৎপরতা বেড়েছে। কিন্তু অনেক স্পটে পুলিশের ভয়ে যাত্রী ওঠানামা করাতে হয়। অন্যথায় জরিমানা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় কাগজপত্রও দেখেন ট্রাফিক বিভাগের লোকজন। তবে সড়কে যেসব শৃঙ্খলা মানা-না মানা নিয়ে আলোচনা হয় বাস্তবে এর চর্চা খুব কম চালকই করে থাকেন।

গত এক বছরের বেশি সময় রাজধানীতে বড় বড় যে কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এর প্রত্যেকটির জন্য দায়ী বাস চালক। গবেষণাও বলছে, বাসচালকরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পরিবহন মালিক সমিতির লোকজনও এর সঙ্গে একমত। এজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ উন্নতির দেখা নেই।

জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা বাসচালকদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। আশা করি দিন দিন পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এজন্য প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।

ডিএমপিতে সদ্য যোগদানকৃত শিক্ষানবিশ সার্জেন্টদের উদ্দেশে মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ডিএমপির ট্রাফিক ডিভিশনের কাজ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আমি বিশ্বের অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি, মনে হয় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ হয় হাতের ইশারায়। তিনি বলেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নাগরিক সেবার জন্য ডিএমপির একটি সুনাম ও ভাবমূর্তি আছে। আমরা সব সময় চেষ্টা করি এই সুনাম ও ভাবমূর্তিকে অক্ষুণ্ন রাখতে। সুনাম ও ভাবমূর্তি বজায় রেখে প্রত্যেককে দায়িত্ব পালন করতে হবে। দায়িত্ব পালনকালে কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও খারাপ আচরণ করা যাবে না।

স্পেশাল টাস্কফোর্সের অভিযানেও সুফল মিলছে না : পুলিশ বলছে, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ, ট্রাফিক সপ্তাহ, পাক্ষিক কর্মসূচি ও টাস্কফোর্সের কার্যক্রমসহ সব রকমের অভিযান চলমান। ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষে ১৯৮৩ সালের মোটরযান আইনে ১৬ অপরাধে চালকসহ পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে গত ২৪ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত স্পেশাল টাস্কফোর্সের কার্যক্রম চলমান থাকবে।

গত ২৩ এপ্রিল অভিযানের ২৯তম দিনে রাজধানীতে ৮৩৮ গণপরিবহন তল্লাশি করে ট্রাফিক আইন অমান্যকারী ১৩২ গাড়ির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন, ১৮২ গাড়ি রেকারিং ও ৯ গাড়ি ডাম্পিং করেছে। তার মধ্যে ট্রাফিক পূর্ব বিভাগ চাঁনমারি ও জুরাইন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ২৩৫ গাড়ি তল্লাশি, ৩০ গাড়ির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন ও ৭০ গাড়ি রেকারিং করে। ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগ মিরপুর-১ ও মিরপুর-১০ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ১৬১ গাড়ি তল্লাশি করে ৩৬ গাড়ির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন, ১১ গাড়ি রেকারিং ও ৮ গাড়ি ডাম্পিং করে।

ট্রাফিক উত্তর বিভাগ এয়ারপোর্ট রোড, খিলক্ষেত ও ইসিবি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ১৯২ গাড়ি তল্লাশি করে ৩১ গাড়ির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন ও ৫১ গাড়ি রেকারিং করে। এদিকে ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগ জিরো পয়েন্ট ও গোলাপশাহ্ মাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ২৫০ গাড়ি তল্লাশি করে ৩৫ গাড়ির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন, ৫০ গাড়ি রেকারিং ও একটি গাড়ি ডাম্পিং করে। অভিযানকালে ফিটনেসবিহীন-রুট পারমিটহীন গণপরিবহন, ইন্টারসেকশনে এবং বাসস্ট্যান্ডে প্রতিযোগিতামূলক-আড়াআড়িভাবে চলাচলরত এবং অন্য পরিবহনকে বাধা প্রদানকারী গণপরিবহন, যত্রতত্র থামানো, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা করা, দরজা খোলা রেখে গণপরিবহন চালানো, লক্কড়-ঝক্কড় এবং মডেল আউট বাসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয় স্পেশাল টাস্কফোর্স।

পুলিশের ২১ সুপারিশ : এত কিছুর পরও পরিবহন সেক্টরে কেন শৃঙ্খলা ফেরে না। কেনই বা সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ রাজধানীর পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২১ সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, রাজধানী ঢাকা শহরে প্রায় ২৫০ বাস কোম্পানির সাত হাজার বাস বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। নগরীর বেশিরভাগ যাত্রী কর্মস্থলসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এ সব বাসের মাধ্যমে প্রতিদিন যাতায়াত করে থাকেন। মূল সড়ক দিয়ে যত ধরনের পরিবহন চলাচল করে তার মধ্যে শুধু বাসকেই রাস্তার নির্দিষ্ট স্টপেজে যাত্রীর জন্য দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। ফুটপাথ দিয়ে যেসব পথচারী চলাচল করে তার একটি বড় অংশ বাসের যাত্রী। প্রতিদিন চলাচলরত লাখ লাখ পথচারীগণকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ। বাসগুলো যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে বাসের যাত্রী অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য।

এজন্য বাসের মডেল নির্ধারণ করতে হবে। ঢাকা শহরের মূল সড়কগুলো থেকে ছোট বাস উঠিয়ে দিয়ে শতভাগ বড় বাস চালানো যেতে পারে। প্রত্যেকটি বাস হবে দুই দরজাবিশিষ্ট। একই সঙ্গে সামনের দরজা দিয়ে যাত্রী উঠবে এবং পেছনের দরজা দিয়ে যাত্রী নামবে। এতে যাত্রী ওঠানামার সময় কম লাগবে। বাসে যাত্রী সহজে ওঠানামা ও বসার জন্য সিটগুলো হবে পাশাপাশি দুই আসনবিশিষ্ট। মাঝখানে দুইজন যাত্রী অনায়াসে চলাচলের জায়গা থাকবে। মাঝখান দিয়ে এক লাইনে যাতে যাত্রী দাঁড়াতে পারে। বাকি লাইন দিয়ে যাত্রী যাতে চলাচল করতে পারে। সিটগুলোর মাঝে একটু জায়গা বেশি থাকবে যাতে যাত্রী ঢুকতে ও বের হতে সমস্যা না হয়। বাসগুলোর দুটি হাইড্রোলিক দরজা থাকবে যাতে যাত্রী ওঠানামা করার পর চালক সুইচ টিপে অটো ব্যবস্থায় হাইড্রোলিক দরজা বন্ধ করতে পারেন।

বাস স্টপেজের মডেল : বাস স্টপেজগুলো ইন্টারসেকশন হতে একটু দূরে সুবিধাজনক স্থানে হবে। প্রতিটি বাস স্টপেজে যাত্রী দাঁড়ানোর জন্য যাত্রীছাউনি থাকলে ভালো হয়। বাস স্টপেজে বাসের টিকেট কাউন্টার থাকতে হবে। যেখানে যাত্রীছাউনি নেই সেখানে ছাতা ও চেয়ার-টেবিল দিয়ে টিকেট কাউন্টার করতে হবে। কতটুকু এলাকার মধ্যে বাস স্টপেজ হবে তা বাস স্টপেজ শুরু এবং বাস স্টপেজ শেষ সাইনবোর্ড দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে। বাস স্টপেজ শুরু ও শেষের সাইনবোর্ডের মধ্যে ফুটপাথ ঘেঁষে কতটি বাস দাঁড়াতে পারবে তা ব্লক আকারে রোড মার্কিং করে চিহ্নিত করতে হবে।

এছাড়া শতভাগ যাত্রীকে টিকেট নিয়ে বাসে উঠতে হবে, পথিমধ্যে বাস দরজা বন্ধ করে চলবে, লক্কড়-ঝক্কড় বাস দ্রুত মেরামত করতে হবে, বাসের ভেতরে ও বাইরে নিয়মিত পরিষ্কার করা, শ্রমিক কল্যাণ, বাস সার্ভিস পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক তদারকি, দক্ষ ও অভিজ্ঞ চালক তৈরিতে ব্যবস্থা নেওয়া, বাস রাখার স্থান, বাসের অবস্থান চিহ্নিতকরণ, বাসের গায়ে রুটের বর্ণনা উল্লেখ করা, বাসের সিস্টেম উন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বয় সভা, সিসি ক্যামেরা/ভিডিও মনিটরিং, বাস স্টপেজে ট্রাফিক ডিউটি দেওয়া, লক্কড়-ঝক্কড় বাস পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া, বাসরুট ফ্রান্সাইজ এবং প্রচলিত বাস ব্যবস্থাপনা, ইন্টারসেকশন ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকা শহরে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা কমাতে হলে উন্নত বাস ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই এমন পরামর্শ দিয়ে নিজের লেখায় বলেন, প্রাইভেট গাড়ির যাত্রীদের জোর করে বাসে তোলা যাবে না। সঠিক ভাড়ায় উন্নত সেবা দিয়ে অধিকাংশ যাত্রীদের এসি/নন-এসি বাসমুখী করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পরিবহন মালিক, শ্রমিক, ডিএমপি, ডিটিসিএ, বিআরটিএ, বিআরটিসি, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঠিক উদ্যোগ। সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছা থাকলে ঢাকা শহরে ভালো বাস সার্ভিস উপহার দেওয়া ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এই ট্রাফিক কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads