• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
শঙ্কা থাকলেও ট্রেনেই স্বস্তি

ছবি : সংগৃহীত

যোগাযোগ

শঙ্কা থাকলেও ট্রেনেই স্বস্তি

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৩ আগস্ট ২০১৯

ঈদুল আজহা আসন্ন। জীবিকার প্রয়োজনে রাজধানী, বিভাগীয় শহর ও বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করা মানুষ প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরবেন। ব্যক্তিগত যানসহ সড়ক, রেল ও আকাশপথে বাড়ি ফিরবেন তারা। ব্যক্তিগত যান ও উচ্চমূল্যের আকাশপথ বাদ দিলে রেলপথই বেশি মানুষের পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য। গতকাল শুক্রবার কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিটপ্রত্যাশী একাধিকজন এমন মত পোষণ করেন।  

এর মধ্যে কিছু শঙ্কাও আছে। রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা আছে। আছে ইঞ্জিন সংকটও। বর্তমান প্রেক্ষিতে বড় সংকট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ সঠিক সময়ে মেরামত না হওয়া। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চলমান বন্যায় দেশের অনেক স্থানে রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারা দেশে রেলওয়ের ৭টি রুটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার রেলপথ। বিভিন্ন স্থানে রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রেলসড়ক ভেঙে পানির তোড়ে ভেসে গেছে। কোথাও মাটি ও পাথরসহ দেবে গেছে রেলপথ। এ অবস্থায় বর্তমানে রেল চলাচলে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটছে। এর মাঝে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, বন্যায় রেলপথের ওপর প্রভাব পড়বে ঈদুল আজহার ট্রেনযাত্রায়।

তবু কোরবানির ঈদে ট্রেনেই যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। ঈদযাত্রার আগাম টিকিট বিক্রির শেষ দিন ছিল গতকাল শুক্রবার। এদিন ট্রেনের টিকিট বিক্রির পঞ্চম দিনে ১১ আগস্টের অগ্রিম টিকিট দেওয়া হয়। টিকিটপ্রত্যাশীদের ব্যাপক চাপও পরিলক্ষিত হয় এদিন। 

কমলাপুর রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, গত সোমবার থেকে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি চলে। অন্যবারের চেয়ে এবার চাপ বেশি বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসেবে কমলাপুর রেলস্টেশনে লালমনিরহাটের একজন যাত্রী বলেন, এবার উত্তরাঞ্চলের বন্যায় বিভিন্ন স্থানে সড়ক ধসে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও ট্রেনে আরামে ও নিরাপদে যাওয়া যায়। আর এ কারণেই ট্রেনে চাপ এত বেশি।

নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে গতকাল ভোরে কমলাপুর স্টেশনে আসেন আরিফ হাসান। তিনি যাবেন খুলনায়। কাজ করেন একটি স্টিল মিলে। গত ঈদে বাড়ি যেতে পারেননি। এবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই আগামী ১১ তারিখের টিকিট সংগ্রহ করতে এসেছেন তিনি। তিনি বলেন, ৪ ঘণ্টা পরও টিকিট হাতে পাইনি। একজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বিশাল কষ্ট উপেক্ষা করে ঈদের আগের দিন অর্থাৎ ১১ আগস্টের টিকিট পেতে এত সময় নষ্ট করেছি।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশনে অবস্থান নেন হাজারো মানুষ। তাদেরই একজন দিনাজপুর সদর থানার অধিবাসী কালাম মিয়া। তিনি বলেন, টিকিট পেয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। সব কষ্টের কথা ভুলে গেছি।

এদিকে টিকিট বিক্রিতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পুরনো, যা এবারো ছিল। যদিও কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ আমিনুল হক জানান, সুষ্ঠুভাবে টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। তবে অনিয়ম রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন।

এবারো রাজধানী ঢাকার পাঁচটি স্থান থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়েছে। একজন ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কিনতে পারেন। গত ২৯ জুলাই দেওয়া হয় ৭ আগস্টের টিকিট। এ ছাড়া ৩০ জুলাই ৮ আগস্টের, ৩১ জুলাই ৯ আগস্টের, ১ আগস্ট ১০ আগস্টের টিকিট বিক্রি হয়েছে।

তৎপর রেলওয়ে জেলা পুলিশ : এদিকে ট্রেনে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে রেলওয়ে জেলা পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানান রেলওয়ে পুলিশ সুপার নওরোজ হোসেন তালুকদার। তিনি বলেন, ট্রেনে যাত্রাকালে প্ল্যাটফর্মে বা রেলস্টেশনে যাত্রীরা যাতে কোনো অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করে, সে ব্যাপারে আমরা প্রচার চালাচ্ছি। সেইসঙ্গে গুজবে কান না দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্যও লিফলেট বিতরণ করছি। তিনি আরো বলেন, যে কোনো বিষয়ে সন্দেহ হলে তাৎক্ষণিক আমাদের কিংবা নিকটস্থ থানায় জানাতে সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে ৯৯৯-এ কল করে সাহায্য নিতে পারেন।

ইঞ্জিন নিয়ে শঙ্কা : এসবের মাঝেই রেলওয়ের ইঞ্জিন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সংস্থাটির ইঞ্জিন সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানোর কারণে বিকল হয়ে যাচ্ছে মাঝপথে। এমনও দিন গেছে, একদিনে তিনবার ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় ঘটনা ঘটেছে। আসন্ন ঈদযাত্রায় এ নিয়ে বড় শঙ্কায় রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে লোকোমোটিভের সংখ্যা ১৫০টি। এর মধ্যে ১০৫টি কার্যকর। বিদ্যমান ট্রেনগুলো স্বাভাবিকভাবে পরিচালনায় ১১১টি ইঞ্জিনের প্রয়োজন। কিন্তু ট্রেন চালানো হচ্ছে ১০০টি ইঞ্জিন দিয়ে। ফলে রেলের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। চলতি বছরের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে আন্তঃনগর, মেইল, লোকাল ও গুডস ট্রেনের প্রায় ৪০টি ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে। শুধু দুই মাসেই ৪০টি ইঞ্জিন বিকল হয়। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনের ইঞ্জিন ছিল ১৪টি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের যান্ত্রিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রেলের ১৫০টির মধ্যে ৪৭টি ইঞ্জিন অর্থনৈতিক আয়ুষ্কালের মধ্যে রয়েছে (২০ বছর)। এছাড়া ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৩৪টি এবং ৩০ বছরের অধিক বয়সী ইঞ্জিন রয়েছে ৬৯টি। অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলে মোট ইঞ্জিনের ১০৩টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। পূর্বাঞ্চলে সর্বশেষ ইঞ্জিন যুক্ত হয় ২০১১ সালে। ওই সময় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১১টি ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও রেলের বহরে কোনো ইঞ্জিন যুক্ত হয়নি। এ অবস্থায় প্রায়ই নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের। সেই শঙ্কা রয়ে গেছে এবারের ঈদ যাত্রায়ও।

রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলতি বছরের মে মাস থেকে ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা বেড়েছে। এ সময়ে প্রায় ৪০টি ইঞ্জিন বিকল হয়েছে। ইঞ্জিন বিকল হলে একই রুটের অন্যান্য ট্রেনের শিডিউলও বিপর্যয় হয়। ঈদযাত্রায় ইঞ্জিন বিকল হলে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়বে। নতুন ইঞ্জিন সরবরাহ ও পুরনো ইঞ্জিন মেরামত করা না গেলে দুর্ভোগ বাড়বে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের যান্ত্রিক বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, পুরনো ইঞ্জিন দিয়েই ট্রেন চালানো হবে। ঈদযাত্রায় ইঞ্জিন বিকলের শঙ্কা থাকলেও আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছি। ভারত থেকে যে ২০টি ইঞ্জিন আসার কথা, সেগুলো এলে সংকট কিছুটা কাটবে।

প্রস্তুত রেলওয়ে : বর্তমানে প্রতিদিন ৩৫২টি যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করছে রেলওয়ে। ঈদ উপলক্ষে এগুলোর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরো আট জোড়া বিশেষ ট্রেন। ট্রেনগুলো হলো দেওয়ানগঞ্জ ঈদ স্পেশাল, চাঁদপুর ঈদ স্পেশাল (দুই জোড়া), সান্তাহার ঈদ স্পেশাল, লালমনি ঈদ স্পেশাল, খুলনা ঈদ স্পেশাল ও শোলাকিয়া স্পেশাল (দুই জোড়া)। স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেনগুলোয় আসন রয়েছে ২৬ হাজার ৫০০টি। বিশেষ ট্রেনগুলো (ঢাকা থেকে চারটি) যোগ হলে এ আসন সংখ্যা চলে যাবে ৩০ হাজারের কাছাকাছি।

গত ঈদুল ফিতরে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৪১০টি কোচ দিয়ে যাত্রীসেবা পরিচালনা করেছিল রেলওয়ে। এবার সেটি বেড়ে ১ হাজার ৪৩৭টিতে উন্নীত হয়েছে। নতুন যোগ হওয়া কোচগুলো সরবরাহ করেছে সংস্থাটির পাহাড়তলী ও সৈয়দপুর ওয়ার্কশপ। ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ঈদের সময় সবকটি আন্তঃনগর ট্রেনের সাপ্তাহিক ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে ১৯টি ও পশ্চিমাঞ্চলে আরো ২৯টি বাড়তি ট্রিপ পরিচালনা করা সম্ভব হবে। ঈদে যাত্রীসেবার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২২৬টি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। শুধু ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোই নয়, যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের সুবিধার্থে ঈদের তিনদিন আগেই বন্ধ করে দেওয়া হবে পণ্যবাহী ট্রেন (কনটেইনার ও জ্বালানি তেলবাহী ট্রেন বাদ দিয়ে)।

টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে যেন কোনো অনিয়ম না হয়, সেজন্য গঠন করা হয়েছিল বিশেষ পর্যবেক্ষক দল। একইভাবে চলন্ত ট্রেনে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে আরএনবি ও জিআরপির কার্যক্রম আরো জোরদার করা হচ্ছে। এ কাজে র্যাব, বিজিবি, স্থানীয় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেবে রেলওয়ে।

রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রতি ঈদেই যাত্রীসেবা দেওয়ার জন্য রেলওয়ে বিশেষ প্রস্তুতি নেয়। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ঘরমুখী মানুষকে নিরাপদে পৌঁছানো এবং ঈদের পর তাদের নিরাপদে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য রেলওয়ের কর্মীরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। আশা করছি, এবার রেলপথে স্বস্তি নিয়ে যাতায়াত করতে পারবে মানুষ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads