• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

রেল সম্প্রসারণে বহুমুখী পদক্ষেপ সরকারের

  • মো. রেজাউর রহিম
  • প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশ রেলওয়েকে দেশের সব জেলায় সম্প্রসারণ এবং রেলকে গণবান্ধব পরিবহনে রূপান্তরে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপজেলা ভোলা ছাড়া সব জেলায় সম্প্রসারণের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের মানোন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে রুট সম্প্রসারণ, নতুন রেললাইন ও রেলসেতু নির্মাণ, নতুন রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আরো নতুন রুটে রেল চালু এবং রেলওয়ের ব্যাপক আধুনিকায়নের কাজ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া রেলের গতি বাড়াতে দেশের অধিকাংশ রুটে ডাবল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সড়কপথের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়েকে আরো গতিশীল করে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাড়ানোর পাশাপাশি রেলের আধুনিকায়ন ও নতুন নতুন রুট চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি আরো রেলসেতু নির্মাণ ও মেরামত ও আধুনিকায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী রেলপথ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, উন্নয়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সরকার সড়ক, নৌ ও বিমানপথের যেমন উন্নয়ন করেছে, ঠিক তেমনি দেশের স্বার্থে রেলের উন্নয়নে আলাদা মন্ত্রণালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি বলেন, দেশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা রেললাইন দেখেনি এবং আমরা রেললাইন ও রেলকে তাদের দোড়গাড়ায় নিয়ে যাব, এজন্য আমরা নতুন রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করছি। সম্প্রতি ঢাকা-বেনাপোল রুটে ট্রেন চালুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, রেল খাতের উন্নয়নে শুধু বগি ও ইঞ্জিন সংগ্রহ করেলই চলবে না। এজন্য রেলের ব্যাপক সম্প্রসারণ ও নতুন রুট চালু ও রেল যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবলও নিয়োগ করতে হবে। রেলের আধুনিকায়ন ও গতিশীল করার পাশাপাশি দেশের মানুষের দোড়গাড়ায় পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

রেলওয়ে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে ব্যাপকভাবে কাজ চলছে। রেলের উন্নয়নে চারটি পর্যায়ে বর্তমানে ২৩৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ২০ বছরব্যাপী উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে। জানা গেছে, ভোলা ছাড়া দেশের ৬৩টি জেলায় রেললাইনের আওতায় আসবে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে ট্রান্স এশিয়ান রুটেও বাংলাদেশ রেলওয়েকে সংযুক্ত করা হবে। এছাড়া রেলের উন্নয়নে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের সহযোগিতা নেওয়া হবে। বিশেষ করে এ দেশ দুটির কারিগরি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য রেলমন্ত্রী সম্প্রতি ভারত ও চীন সফরও করেছেন।

রেলের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, রেলের উন্নয়নে বিশেষ করে রেলের গতিশীলতা বাড়ানোর জন্য দেশের বিভিন্ন রুটে ডাবল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মিটারগেজ লাইনগুলোকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর করার কাজ চলছে। এ বছরই টঙ্গী থেকে গাজীপুর চার লাইনে রূপান্তরের কাজ শেষ হবে উল্লেখ করে রেলমন্ত্রী বলেন, আরো বেশি ট্রেন চলাচলের জন্য জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত, ময়মনসিংহ-জামালপুর রুটে এবং দর্শনা-খুলনা রুটে ডাবল লাইন নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।

রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ত্রিপুরার আগড়তলার সঙ্গে ডুয়েল গেজ লাইনের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রুটে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন রুটের আরো সম্প্রসারণ ঘটবে। রেলওয়ে আধুনিকায়নে নীলফামারীর সৈয়দপুর এবং রাজবাড়ীতে আধুনিক মানের দুটি ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মন্ত্রী আরো বলেন, টঙ্গী-লাকসাম সেকশনে এবং লাকসামের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আরো ৭২ কিলোমিটার ডুয়েল গেজে রূপান্তরের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৩৬ কিলোমিটার রেললাইন ডুয়েল গেজে রূপান্তরের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এছাড়া তিনি আরো জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে চারটি ধাপে রেলের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, রেলের সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর রুটের কাজ চলছে। এছাড়া এ বছরই ঈশ্বরদী-পাবনা হয়ে ঢালারচর রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে রেলসংযোগ স্থাপনের কাজও নেওয়া হয়েছে। রেলের গতি বাড়াতে দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন রেলমন্ত্রী।

রেলওয়ে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলের ৪৩টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে এবং অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পপনার অংশ হিসেবে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ লাইনের নির্মাণকাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে দ্বিতীয় রেলসেতু নির্মাণ, যমুনা নদীর ওপর বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি রুটে আরেকটি রেলসেতু নির্মাণ, বৈদ্যুতিক রেলপথ চালু, খুলনা-পার্বতীপুর রুটে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া রেলওয়েতে আরো ৬০০টি ইঞ্জিন, ছয় হাজার যাত্রীবাহী কোচ ও সাত হাজার মালবাহী ওয়াগন কেনা হবে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন রুটে বৈদ্যুতিক ট্রেন ও বুলেট ট্রেনসহ দ্রুতগামী ট্রেন চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বুলেট ট্রেন চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জল হোসাইন বলেন, বর্তমানে দেশের ৪৪টি জেলায় রেলপথ চালু রয়েছে। ২০৪৫ সাল নাগাদ ভোলা ছাড়া দেশের ৪৩টি জেলায় রেলের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রেলের গতিশীলতা বৃদ্ধি, রেলপথ সম্প্রসারণ এবং আধুনিকায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। নতুন রেললাইন নির্মাণের পাশাপাশি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবার মানোন্নয়নে দক্ষ জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। রেলের সেবার মান বৃদ্ধিকল্পে মাঠপর্যায়ে রেলকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং টিকিট কালোবাজারি বন্ধসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। জাইকার অর্থায়নে যমুনা নদীর ওপর দ্বিতীয় রেলসেতু নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে উল্লেখ করে রেলসচিব বলেন, এ প্রকল্পের টেন্ডারের প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া বর্তমানে দেশে তিন হাজার ১০০ কিলোমিটার চালু রেললাইন এবং রুট লাইনের পরিমাণ চার হাজার কিলোমিটারের ওপরে বলেও জানান সচিব।

জানা গেছে, আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে কন্টেইনারবাহী ওয়াগন বৃদ্ধির জন্য নতুন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ডুয়েলগেজ রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে পূর্ব ও পঞ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি ট্রেন চালু এবং পদ্মা নদীর ওপর আরো একটি রেলসেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। রেলের আধুনিকায়নে দেশের রেলওয়ে অপারেশনকে বর্তমানের চারটি জোনে বিকেন্দ্রীকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, উন্নত স্টেশন ও বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করতেও বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারি ফান্ডের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ভারত, চীন, জাপানের সহযোগিতা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, রেলের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ১৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার। আর আগের অর্থবছরে এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ২৩১ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads