• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
অন্ধকারে সড়ক আইন

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

অন্ধকারে সড়ক আইন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

গত বছর রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম মারা যায়। পরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে উত্তাল হয় দেশ। আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল সড়ক পরিবহন আইন। এর মাঝে কেটে গেছে এক বছর। চালকদের অপরাধ জামিনযোগ্য হওয়া এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতায় শিথিলতার দাবি জানিয়ে আইনটির বিরোধিতা করেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তাদের বিরোধিতার মুখে সংসদে পাস হওয়ার এক বছরেও কার্যকর করা যায়নি সেই সড়ক পরিবহন আইন।

এদিকে আইন কার্যকর না করেই এ বছরের শুরুর দিকে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের নেতৃত্বে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি সম্প্রতি ১১১টি সুপারিশও তুলে দিয়েছে সেতুমন্ত্রীর হাতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন পাস না করে এ ধরনের উদ্যোগ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করবে। এ খাতে অরাজকতা বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

সংসদে সড়ক পরিবহন আইন পাস : সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া দীর্ঘদিন থেকেই ঝুলে ছিল। গত বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের রেষারেষিতে দিয়া-করিম প্রাণ হারালে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের মুখে ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটির খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ১৩ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বিল’ সংসদে উত্থাপন করা হয়। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে পাস হয়। রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর ৮ অক্টোবর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। তবে আইনটির ১(২) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির গেজেটের পর আইনটি কার্যকর করতে সরকারের পক্ষ থেকেও গেজেট প্রকাশ করতে হবে। সেই গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় এখনো কার্যকর হয়নি আইনটি।

আইনে উল্লেখযোগ্য যা আছে : সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৬ ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৮ বছর, পেশাদারদের ক্ষেত্রে ২০ বছর। একই ধারার (গ) উপধারায় বলা হয়েছে, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য ৯৮ ও ১০৫ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। ১০৫ ধারায় বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ৯৮ ধারায় সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আর গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করলে বা ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ক্ষেত্রে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইনে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আপত্তি : আইনটি প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরপরই এর বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন পরিবহন শ্রমিকরা। ৮ দফা দাবিতে ২৮ অক্টোবর থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটও পালন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।

শ্রমিকদের দাবি, সড়ক পরিবহন আইনে সব ধারা জামিনযোগ্য করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের অর্থদণ্ড ৫ লাখ টাকার বিধান বাতিল করতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির বদলে করতে হবে পঞ্চম শ্রেণি। আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধানেও শৈথিল্য দাবি করেন তারা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন আইনে চালকদের শাস্তি অজামিনযোগ্য নেই। সে জায়গায় শিথিল করতেই আইনটি সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের পরিবহন খাত এখনো অতটা উন্নত হয়নি যে শিক্ষিত ও ভালো মানের চালক-শ্রমিক পাওয়া সম্ভব। সেসব দিক চিন্তা করেই দাবিগুলো উত্থাপন করা হয়েছে।

শ্রমিক নেতা ওসমান গনি এ প্রসঙ্গে বলেন, সড়ক পরিবহন আইনে শ্রমিকদের অধিকার কিংবা সুরক্ষার বিষয় নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু শ্রমিকদের ঘামে প্রতিষ্ঠিত পরিবহন খাত, সেই শ্রমিকদেরই নানাভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন।

আইন কার্যকর করতে প্রকাশ হয়নি সরকারি গেজেট : ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হওয়ার এক বছর পরও আইন বাস্তবায়নের বিধিমালা তৈরি করতে পারেনি সড়ক মহাসড়ক বিভাগ। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আইনটি পুনঃবিশ্লেষণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে প্রধান করে আইন ও রেলমন্ত্রীকে সঙ্গে রেখে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বলা হয়, ওই কমিটি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে আইনটি পুনঃপর্যালোচনা করে সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আইনটি পুনরায় বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। কীভাবে আইনটি শিথিল করা যায়, সে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক আহ্বান করা হবে। সরকার চায় আইনটি দ্রুতই কার্যকর হোক।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন উদ্যোগ : এদিকে সংসদে পাস হওয়ার পরও আইন বাস্তবায়ন না করেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাজাহান খানের নেতৃত্বে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত মাসে ১১১টি সুপারিশ তুলে দেয় সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর হাতে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে একটি টাস্কফোর্স গঠনে কাজ করেছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল।

বিশেষজ্ঞ মত : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সুপারিশ কখনো বাস্তবায়ন করা হয় না। এমনকি সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন হয়নি। এই সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, ২২ মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ৫ ঘণ্টার বেশি কোনো চালক গাড়ি চালবেন না বলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও তা কতগুলো বাস মালিক বা চালক মেনে চলেছেন? পরপর তিনবার সরকার ক্ষমতায়। এখন পর্যালোচনা করার সময় এসেছে, সড়ক এই বিশৃঙ্খলা বন্ধ না হওয়ার কারণ কী? সুপারিশ, সিদ্ধান্ত কিংবা আইন নয়, সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার প্রধানের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন ড. শামছুল।

সেফ রোডস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্সের (শ্রোতা) বিশেষজ্ঞ সদরুল হাসান মজুমদার জানান, আইনটি প্রণয়নের আগে তারা যেসব সুপারিশ রেখেছিলেন, তার অনেকাংশই রাখা হয়নি। সড়কে দিন দিন দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়লেও এসব ঘটনার তদন্ত ঠিকভাবে হয় না। পরিবহন খাতে নৈরাজ্যও দিন দিন বাড়ছে বলে মত তার। সদরুল বলেন, এই খাতকে রাজনীতি থেকে বের করে নিয়ে আসতে না পারলে মালিক-শ্রমিকদের কাছে সবাইকে জিম্মি থাকতে হবে। আইন বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে তা বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব নয়।

আইন কার্যকর না করে ভিন্ন উদ্যোগ সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ আরো দীর্ঘায়িত করে তুলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। লেখক, সাংবাদিক ও শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পরিবহন খাতে যেন শৃঙ্খলা ফিরে আসে, সংশ্লিষ্টদের স্বার্থও রক্ষা হয়-এমন সিদ্ধান্তে আসতে হবে দুপক্ষকেই।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিরোধিতায় আইনে চালকের সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছরের বদলে ৫ বছর করা হয়েছে। তারপরও সংসদে পাস হওয়া আইন নিয়ে মালিক-শ্রমিকেরা আন্দোলনের নামে যাত্রীদের হয়রানি করেছেন। তিনি বলেন, নতুন সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সড়ক পরিবহন আইনটির যথাযথ প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনটিকে কার্যকর করতে হবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, আইন কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার জায়গা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। একই সঙ্গে পরিবহন খাতও টিকে থাকবে এবং সাধারণ মানুষও নিরাপদে চলাচল করতে পারবে-এমনই চায় সরকার। সেজন্য যা করা দরকার, তা-ই করা হবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads