স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৩১ ও ৩২ নম্বর খুঁটির ওপর ২৩তম (সুপার স্ট্রাকচার) স্প্যানটি বসানো হয়েছে। আজ রোববার দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে জাজিরা প্রান্তে ২৩তম স্প্যানটি বসায় সেতু প্রকৌশলীরা। স্প্যানটি স্থায়ীভাবে বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো সেতুর ৩ হাজার ৪৫০ মিটার অবকাঠামো। ২২তম স্প্যান বসানোর ১০ দিনের মাথায় বসলো সেতুর ২৩তম স্প্যানটি।
পদ্মা সেতুর সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর বাংলাদেশের খবরকে জানান, ২৩তম ‘৬-এ’ স্প্যানটি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার (মাওয়া) কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে থেকে রোববার সকাল সাড়ে ৯টা ০৫ মিনিটে রওনা হয় ভাসমান ক্রেন তিয়ান-ই। মাওয়া থেকে ধূসর রংয়ের ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ হাজার ১৪০ টন স্প্যানটি ৩ হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার 'তিয়ান-ই' ভাসমান ক্রেন নেওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা স্প্যান বসানোর কর্মযজ্ঞ শুরু করে। কয়েক ঘন্টার প্রচেষ্টায় দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে স্প্যানটি বসাতে সক্ষম হন সেতুর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। এর আগে চলতি মাসের ৩১ জানুয়ারি এ স্প্যানটি বসানোর কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বসানো সম্ভব হয়নি।
সেতু প্রকৌশলী সূত্রে জানা যায়, চীন থেকে ৪১টি স্প্যানের মধ্যে পদ্মা সেতু এলাকায় ইতিমধ্যে ৩৫টি স্প্যান এসেছে। যার মধ্যে ২৩টি স্প্যান বসানো হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া কুমারভোগ কন্সস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে এখন ১৩টি স্প্যান রয়েছে। ৪টি স্প্যান মাওয়ায় আসার জন্য সমুদ্র পথে আছে। সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে ৩৬টি খুঁটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। বাকি ৬টি খুঁটির কাজ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সবকটি স্প্যান খুঁটির উপর বসানোর কর্মসূচি রাখা হয়েছে।
সেতুর প্রকৌশলীদের তথ্য মতে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যান, ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটির ওপর দ্বিতীয় স্প্যান, ১১ মার্চ ৩৯ ও ৪০ নম্বর খুঁটির ওপর তৃতীয় স্প্যান এবং ১৩ মে ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটির ওপর ৪র্থ স্প্যান, একই বছরের ২৯ জুন ৫ম স্প্যান বসানোর পর জাজিরা প্রান্তে মূল সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয় ৭৫০ মিটার। অপরদিকে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর মাওয়া প্রান্তে দু’টি খুঁটির ওপর ৬ষ্ঠ স্প্যান বসানোর পর উভয় প্রান্ত মিলিয়ে মূল সেতুর অবয়ব রূপ নেয় ৯০০ মিটারে।
আর গত বছর ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি জাজিরা প্রান্তের ৩৬ ও ৩৭ নম্বর খুঁটির ওপর ৭ম স্প্যান স্থাপনে উভয় প্রান্ত মিলিয়ে দৃশ্যমান হয় ১ হাজার ৫০ মিটার। ২০ ফেব্রুয়ারি জাজিরা প্রান্তে ৩৫ ও ৩৬ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ‘৬-ই’ নম্বর ৮ম স্প্যান। মূল সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয় এক হাজার ২’শ মিটার। ২১ মার্চ একই প্রান্তের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর খুঁটির উপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ‘৬-ডি’ নম্বরের ৯ম স্প্যান বসানোর পর অবকাঠামো আরও এক ধাপ বৃদ্ধি পেয়ে দৈর্ঘ্যে রুপ নেয় এক হাজার ৩৫০ মিটারে। ১০ এপ্রিল মাওয়া প্রান্তে ১৩ ও ১৪ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ‘৩এ’ নম্বরের পদ্মা সেতুর ১০ম স্প্যান। সেতুর মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়ে দেড় কিলোমিটারে। ২৩ এপ্রিল জাজিরা প্রান্তে ৩৩ ও ৩৪ নম্বর খুুঁটির উপর বসানো হয় ১১ তম স্প্যান। এ স্প্যানটি বসানোর পর পদ্মা সেতুর মূূল অবকাঠামো দৃশ্য হল ১ হাজার ৬৫০ মিটার। ৬ই মে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝামাঝি স্থানে পদ্মা সেতুর ২০ ও ২১ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ১২তম স্প্যান। ২৫ মে মাওয়া প্রান্তের ১৪ ও ১৫ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় ১৩তম স্প্যান। ফলে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়ে উঠে এক হাজার ৯৫০ মিটার। পরে ১৪ অক্টোবর জাজিরা প্রান্তের ২৮ ও ২৯ নম্বর খুুঁটির ওপর স্থাপন করা হয় ১৪ মে স্প্যান এবং ২২ অক্টোবর জাজিরা প্রান্তের ২৮ ও ২৯ নম্বর খুঁটির ওপর ১৫তম স্প্যান বসানো হয়। আর এ স্প্যান বসানোর ২৮ দিনের মাথায় মাওয়া প্রান্তের ১৬ ও ১৭ নম্বর খুঁটির ওপর ১৬ তম স্প্যান বসানোর পর মূল সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ২ হাজার ৪০০ মিটারে। ২৬ নভেম্বর জাজিরা প্রান্তের ২২ ও ২৩ নম্বর খুঁটির ওপর ‘৪ডি’ নম্বরের ১৭ তম স্প্যান বসানোর পর পদ্মার সেতুর মূল অবকাঠামো ২৫৫০ মিটার বা আড়াই কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ১১ ডিসেম্বর জাজিরা প্রান্তের ১৭ ও ১৮ নম্বর খুঁটির ওপর বুধবার বসানো হয় পদ্মা সেতুর ১৮তম স্প্যান। ১৮ ডিসেম্বর ১৯তম স্প্যান বসানো হয় ২১ ও ২২ নম্বর খুঁটির ওপর। মূল সেতুর অবকাঠামো দৈর্ঘ্যে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ২ হাজার ৮’শ ৫০ মিটারে। গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তের ১৮ ও ১৯ নম্বর খুঁটির ওপর ধূসর রঙের ‘৩-এফ’ নম্বরের ২০ তম স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে সেতুর ৩ কিলোমিটার। আর এ বছরের প্রথম মাসের ১৪ জানুয়ারি জাজিরা প্রান্তের ৩২ ও ৩৩ নম্বর খুঁটির ওপর ধূসর রঙের ‘৪-সি’ নম্বরের ২১তম স্প্যান বসানো হয়েছে। ২৩ জানুয়ারি মাওয়া প্রান্তে ২২তম স্প্যান বসানো হয়েছে ৫ ও ৬ নম্বর পিলারের উপর। এবং গতকাল রোববার জাজিরা প্রান্তে ৩২ ও ৩৩ নম্বর খুঁটির উপর ২৩তম স্প্যানটি বসানোর মধ্যে দিয়ে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর দৃশ্যমান হয়ে উঠলো ৩ হাজার ৪৫০ মিটার।
উল্লেখ্য, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দ্বিতল পদ্মা সেতুতে সব মিলিয়ে ৪২টি খুঁটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে ২১টি ও জাজিরা প্রান্তে ২১টি খুঁটি। আর ৪২টি খুঁটির ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। এর মধ্যে ৪০টি খুঁটি থাকবে পানিতে আর ডাঙায় ২টি খুঁটি। ডাঙায় থাকা দু’টি খুঁটি সংযোগ সড়কের সঙ্গে মূল সেতুকে যুক্ত করবে। ছয়টি মডিউলে বিভক্ত থাকবে সেতু। মাওয়া প্রান্তে এক হাজার ৪৭৮ মিটার ভায়াডাক্ট (ঝুলন্ত পথ) থাকবে। জাজিরা প্রান্তে থাকবে এক হাজার ৬৭০ মিটার। বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দ্বিতল পদ্মা সেতুর পুরোটাই নির্মিত হবে স্টিল ও কংক্রিট স্টাকচারে। সেতুর ওপরে থাকবে কংক্রিটিং ঢালাইয়ের চাল লেনের মহাসড়ক আর তার নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে এ পদ্মা সেতুর।