• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

হিট লিস্টে থাকা বিশিষ্টজনের অভিমত

পাহাড়া দিয়ে ‘টার্গেট কিলিং’ ঠেকানো সম্ভব নয়

  • শরীফ খিয়াম
  • প্রকাশিত ০৫ মার্চ ২০১৮

মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারী-বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও শিক্ষক ড. জাফর ইকবালের ওপর পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার ঘটনায় শঙ্কিত ইসলামী উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রকাশিত হিট লিস্টে থাকা একাধিক ধর্মনিরপেক্ষ লেখক ও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীরা। তারা মনে করছেন, নিরাপত্তা দিয়ে ‘টার্গেড কিলিং’ ঠেকানো সম্ভব নয়। এই উগ্রবাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে দরকার সামাজিক আন্দোলন। একই সঙ্গে এ-জাতীয় হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার সুনিশ্চিত করা।

হুমকি পাওয়া ব্যক্তিরা বাংলাদেশের খবরকে আরো বলেছেন, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর তাদের অনেকের নিরাপত্তা জোরদার করেছে সরকার। তবু এ ঘটনা মৌলবাদবিরোধীদের বিদেশমুখিতা বাড়াবে বলে ধারণা করছেন তারা।

বেনামি এক মুঠোফোন বার্তায় ২০১৫ সালে নভেম্বরে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাংলাদেশের খবরকে গতকাল রোববার তিনি বলেন, ‘জাফরের ঘটনাটা ঘটার পরপরই আমার বাড়িতে প্রটেকশন দেওয়া হয়েছে। নরমালি আমার বাড়িতে প্রটেকশন থাকে না। কখনো কখনো থাকে। যেমন গ্রন্থমেলার শুরুতেও ছিল। আমি মনে করি সরকার যথেষ্ট করছে। যতদূর সম্ভব চেষ্টা করছে আমাদের রক্ষা করার।’ 

প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই প্রবীণ শিক্ষকের অভিমত, ‘এ ধরনের আক্রমণ এড়ানোর কোনো উপায় থাকে না। কেউ যদি সঙ্কল্প করে যে, সে নিজের জীবনের পরোয়া না করে একজনকে আক্রমণ করবে, তাহলে তাকে ঠেকানো খুব কঠিন হয়। যেমন আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের হত্যাকাণ্ডগুলো। ওদের নিরাপত্তাব্যবস্থা কি কম শক্তিশালী? তারপরও ওরা ঠেকাতে পারেনি। এটা ঠেকানো খুব মুশকিল।’

ব্যাঙের ছাতার মতো জঙ্গি গজাচ্ছে উল্লেখ করে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্র যে একটা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রধর্মের বিধান রেখেছে, এটাও জঙ্গিদের উৎসাহিত করছে। কারণ তাদের বোঝানোই হয় তাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ, অন্যরা হত্যাযোগ্য। কিশোর-তরুণদের এমন ভ্রান্ত আদর্শের প্রতি টান বা আকর্ষণ, দেশে এ অবস্থা তৈরি করেছে। এটা একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের সাহায্য নিয়ে চলতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের উচিত সামাজিকভাবে মৌলবাদীদের প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালানো। অভিভাবক-শিক্ষকসহ সবাই মিলে কাজটা করতে হবে, আরো সচেতন হতে হবে।’

কয়েক বছর ধরেই হিট লিস্টে রয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নাম। বাংলাদেশের খবরকে তিনিও বলেন, ‘প্রটেকশন থাকলেও অতর্কিত হামলা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে হুমকিপ্রাপ্তদের আরো সতর্ক থাকা উচিত।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নতুন করে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো দরকার নেই। তবে যেটুকু আছে সেটুকু কার্যকর রাখা দরকার। যেমন স্যারের হামলাকারীরা বহুক্ষণ ধরে তার পেছনেই দাঁড়ানো ছিল। তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের এটা খেয়াল করে তাদের আগেই সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। স্যারের নিজেরও উচিত ছিল বিষয়টা খেয়াল করা। তিনি জিজ্ঞেস করতে পারতেন তোমরা কারা।’

ইনু আরো বলেন, ‘আমিও অনেক সময় এমন বেখেয়াল থাকি। অনেক সময় ছবি তোলার কথা বলে আমার পেছনে এসেও ওভাবে দাঁড়ায়। কিন্তু এ ঘটনায় সতর্ক হয়ে গেছি। আমি আজ বলে দিয়েছি, অমনটা আর করা যাবে না। ছবি তুলতে হলে সামনে এসে তুলতে হবে। আর দায়িত্ব পালনের সময় নিরাপত্তাকর্মীদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।’

বাংলাদেশের খবরকে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গিবাদ একটি ভয়াবহ সমস্যা। বর্তমান সরকার এটাকে কঠোর হস্তে দমন করার ফলে তারা কাবু হয়েছে, পিছু হটেছে। কিন্তু আত্মসমর্পণ যেহেতু করেনি, সেহেতু বিপদটা এখনো আছে। জঙ্গিরা এখন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হামলা করছে।’ তার অভিমত, ‘জাফর স্যারের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো ওরা শেষ হয়ে যায়নি, শোধরায়নি। অতএব এখন তাদের সমূলে ধ্বংস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। শুধু জঙ্গিদের নয়, তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও ধরা দরকার। সাপ এবং সাপের ডিম, সবই ধ্বংস করা উচিত।’ ইনু আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে জঙ্গিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম কেন, কোনো ধর্মই এ-জাতীয় উসকানিমূলক নৈরাজ্যকে সমর্থন করে না। জঙ্গিবাদ একটি স্বতন্ত্র ধারা, যা ভাইরাসের মতো সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।’

জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হিট লিস্টে থাকা আরেকজন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও কর্মী সাকিল আহমেদ অরণ্য। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘কেবল গুটিকয়েক মানুষকে নিরাপত্তা নয়, সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। প্রশ্ন হচ্ছে, কেবল নিরাপত্তা দিয়েই কি এসব হত্যা বন্ধ করা সম্ভব, অবশ্যই না। জাফর ইকবালের ওপর হামলা সেটাই প্রমাণ করে।’ অরণ্যের অভিমত, ‘আসলে জঙ্গিবাদী ধারার বিপরীতে যে ধারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তা কেবল আমরা মুখে আওড়াই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চেতনা বলে কেবল মুখে ফ্যানা তোলাই হয়, তা সত্যিকারের প্রয়োগ করার যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সেটা নেওয়া হয়নি আজো। ভোটের হিসাব কষতে গিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নানা সময় মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলেই আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’

অরণ্যের সুরেই কথা বলেন হিট লিস্টে থাকা গণজাগরণ মঞ্চের আরেক সংগঠক ও কর্মী বাপ্পাদিত্য বসু। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘মৃত্যুকে মুঠোবন্দি করে বেঁচে আছি। কে মারবে সে ভয়ে তো আর পালিয়ে বেড়াতে পারি না। বাংলাদেশের জন্য, মানুষের জন্য, সত্যের জন্য লড়াইটা করে যাব।’

গত তিন-চার বছরে হুমকি মাথায় নিয়ে দেশ ছাড়া ব্লগার অমি রহমান পিয়াল, মাহমুদুল হক মুন্সী বাঁধন ও তার স্ত্রী, আজম খান (মহামান্য কহেন), হুমায়ুন আজাদপুত্র অনন্য আজাদ, শাম্মী আক্তার, অভিনেতা ও অ্যাক্টিভিস্ট সৈয়দ জাকির আহমেদ রনি, কর্নেল তাহেরের ভাইজি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) কর্মী শায়লা আহমেদ লোপাসহ আরো অনেকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কমপক্ষে ২০ জনের নাম আমার এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। তবে দেশত্যাগকারীদের সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।’

বাপ্পাদিত্য বসুর অভিমত, ‘ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিয়ে এ জাতীয় টার্গেট কিলিং খুব একটা ঠেকানো যাবে না। সেটা প্রমাণিত স্যারের ঘটনায়। আমি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা চাইও না। আমি চাই সামগ্রিক দেশের নিরাপত্তা। সেটা কীভাবে হবে? দেশের ওপর কারা আঘাত হানতে উদ্যত- সেটা সবাই জানি, তাদের দমন করুন।’

নিউ মিডিয়া ও জঙ্গিবাদবিষয়ক গবেষক নির্ঝর মজুমদার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘হামলাকারী আক্রমণের ব্যাপারে কার দ্বারা বা কিসের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, সেটি জানা সবচেয়ে জরুরি। বিভিন্ন পত্রিকায় আসা হামলাকারীর ভাষ্যমতে, সে জাফর ইকবাল স্যারকে ইসলামের শত্রু বলে মনে করত। এখন দেখার বিষয়, এ ধারণাটা সে কোথা থেকে বা কীভাবে পেয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার যতটুকু বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, সে এ ধরনের হামলার জন্য আংশিকভাবে প্রশিক্ষিত। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এর পেছনে অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তি, কিংবা বড় জঙ্গিগোষ্ঠী দলের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকবেই।’ তিনি বলেন, ‘হামলাকারীর যতদূর ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে পেরেছি, তাতে আমার মনে হয়নি যে সে এই হামলা একাকী চালিয়েছে। কোনো জঙ্গি দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও এমন একাধিক ব্যক্তি নিজ উদ্যোগেও এ-জাতীয় ঘটনা ঘটাতে পারে। এখানে তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি।’

নির্ঝরের মতে, ‘জঙ্গিদের বা জঙ্গি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের উচ্চমাত্রার মোটিভেশন থাকে। এর বাইরে কোনো জঙ্গি দলের হামলাকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ সামরিক মানের। সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ পান না। উপরন্তু তাদের মোটিভেশনও এত ভয়ঙ্কর নয়। সর্বোপরি এরাও মানুষ। ফলে এ ধরনের ঘটনার আকস্মিকতায় তারা সঠিক রেসপন্স দিতে না পারারই কথা। এতে দোষ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেই পুলিশ সদস্যদের নয়। দোষ হলো তাদের হায়ার অথরিটির। যারা এ ধরনের হুমকির প্রকৃতি সঠিকভাবে বিচার করতে পারেনি এবং এর ফলে তারা সঠিক রিসোর্স অ্যালোকেশন করতে পারেননি। বলা যায়, নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয় দেখেই হামলাগুলো ঠেকানো যাচ্ছে না।’

প্রসঙ্গত, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে জঙ্গিবাদীদের ৪৯ হামলায় ৫২ জন প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, মুয়াজ্জিন, ধর্মযাজক, বিদেশি, মানবাধিকারকর্মী, সেবক, দর্জি, মুদি দোকানি, পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের সদস্য, হিন্দু, খ্রিস্টান, ভিন্নধর্ম বা মতাবলম্বী গুপ্তহত্যার শিকার হয়।

এদিকে তাদের ঘোষিত হিট লিস্টে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাংবাদিক আবেদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারসহ শতাধিক ব্যক্তি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads