• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
আরইবি ও তিতাসে দুর্নীতির দুষ্টচক্র

কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে এই দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছে

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

আরইবি ও তিতাসে দুর্নীতির দুষ্টচক্র

নেপথ্যে রাজনৈতিক ছত্রছায়া * অসহায় কর্তাব্যক্তিরা

  • রেজাউল করিম লাবলু
  • প্রকাশিত ০৮ জুন ২০১৮

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবাধ দুর্নীতি চলছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত এই দুই প্রতিষ্ঠানে একশ্রেণির দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে এই চক্র গড়ে তুলেছে। এ কারণে শৃঙ্খলা ফিরছে না প্রতিষ্ঠান দুটিতে। এতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি যশোর-২-এর এক গ্রাহক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, অনলাইনে সংযোগের জন্য আবেদন করলে মাসের পর মাস পড়ে থাকে। কিন্তু স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ানকে ১০ হাজার টাকা দিলে দ্রুত সংযোগ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের এক গ্রাহক বলেন, সেখানে নতুন সংযোগ নিতে ক্ষেত্রভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এই টাকা নেয় স্থানীয় একশ্রেণির দালাল চক্র। চক্রটির বাইরে সংযোগ নিতে ‘ঝামেলা’ হয়। খুলনার দৌলতপুরের এক গ্রাহক জানান, সেখানে বাসার জন্য নতুন সংযোগ নিতে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। ব্যবসায়িক সংযোগে দিতে হয় ১৫ থেকে ৩০ হাজার। না দিলে ‘হাইকোর্ট দেখান’ সংশ্লিষ্টরা; দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকেন। তবে টাকা দিলে আর কোনো ‘ঝামেলা’ থাকে না। এই গ্রাহক বলেন, তাকে মশলা ভাঙানোর মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগের জন্যই দিতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। তারপরও ঘোরানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরইবির এক পদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, দুর্নীতি কমিয়ে প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন সমিতিগুলোকে কার্যকর করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও শৃঙ্খলা ফিরছে না। নতুন সংযোগ নিতে সরকার নির্ধারিত ফি দিয়েও মিলছে না বিদ্যুৎ সংযোগ। বাড়তি অর্থ না দিলে নানা অজুহাতে ঘুরতে হয় মাসের পর মাস। এ খাতে যত অনিয়ম তার সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাদের ‘তুষ্ট’ না করে সংযোগ পাওয়া দুষ্কর।

এ প্রসঙ্গে আরইবির ওয়েবসাইটে ‘কেন্দ্রীয় গ্রাহক অভিযোগের’ জন্য দেওয়া মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, এমন নানা অভিযোগ তারা পান। প্রতিদিনই একাধিক অভিযোগ আসে। যে সমিতির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে সে সমিতির জেনারেল ম্যানেজারকে বিষয়টি জানিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। গত এপ্রিলে ১০৮টি অভিযোগ এসেছিল। সেগুলো লিখিত আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মার্চ মাসে পাঠানো হয় ১০৭টি অভিযোগ। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গ্রাহকরা সরাসরি সমিতিগুলোর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় দালাল চক্রের দ্বারস্থ হন এবং ভোগান্তিতে পড়েন। এ বিষয়ে জানতে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিনের মোবাইলে ফোন করে এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

তিতাসের দুর্নীতি : কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিতাসের দুর্নীতিপ্রবণ এলাকাগুলো হলো নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী শিল্প এলাকা, ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, সাভার ও বাড্ডার ভাটারা। এসব এলাকায় অবৈধ লাইন সবচেয়ে বেশি। এতে জড়িত মূলত ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত তিতাসের দুর্নীতিগ্রস্ত কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে গ্যাসের বৈধ আবাসিক গ্রাহক প্রায় ৩৮ লাখ। এর মধ্যে ২৭ লাখ তিতাসের। এর বাইরে অবৈধ গ্রাহক/সংযোগ আছে ৩ লাখের বেশি। এসব গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার করলেও সরকার বিল পাচ্ছে না। এদিকে বৈধ চাহিদাপত্র নিয়ে সংযোগের অপেক্ষায় আছে প্রায় দেড় লাখ গ্রাহক। তাদের প্রায় ৮০ হাজারই তিতাসের এলাকায়।

তিতাস গ্যাসের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় মাইলের পর মাইল অবৈধ লাইন টেনে সংযোগ দেওয়া হয়। তখন অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ লাইন কাটাও হয়। পরে আবার রাতের আঁধারে তারা অবৈধভাবে সংযোগ নিয়েছিল। বর্তমান সরকার আমলে বাড্ডার ভাটারা এলাকায় অনেক অবৈধ লাইন টেনে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে স্থানীয় এমপির অনুসারীরা বাধা হয়ে দাঁড়ান। তখন অবৈধ লাইন না কেটে ফিরে আসতে হয়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়ে ওঠা অনেক প্রতিষ্ঠানে অবৈধ সংযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো হয়। এজন্য কেউ দুর্নীতিতে জড়াতে ভয় পায়। তারপরও যে দুর্নীতি হয় না তা নয়। দুর্নীতির সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জড়িত রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের নেতাকর্মীরাই এসব অবৈধ সংযোগে জড়িত। তিনি বলেন, এসব নেতাকর্মী তিতাসের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের দিয়ে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে মাইলের পর মাইল লাইন টেনে সংযোগ দেয়। এজন্য যে অর্থ নেওয়া হয় তা ওই নেতাকর্মীরাই ভাগ করে নেন। তিতাস মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও রাতের আঁধারে আবার সংযোগ লাগিয়ে নেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপের জন্য ২০১৫ সালে ১২ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় তিতাস। তাদের মধ্যে দুজনকে বরখাস্ত করা হয়। সে সময় ১১ জন কর্মচারীকেও বরখাস্ত করা হয়। এরপর ২০১৬ সালে বরখাস্ত করা হয়েছে আরো তিন কর্মকর্তাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কখনো কখনো ‘সমাজের প্রভাবশালী লোকজন’ অবৈধ লাইন টেনে গ্যাস সংযোগ নিয়ে থাকেন। ওই লাইন বিচ্ছিন্ন করতে গেলে অনেক সময় বাধার মুখোমুখি হতে হয়, যা কোম্পানির পক্ষে সুরাহা করা ‘দুঃসাধ্য’। এটা পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দরকার।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। তাই বলা যায়, তিতাসের এলাকায় অবৈধ সংযোগ নেই। মাইলের পর মাইল অবৈধ সংযোগের বিষয়টি সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিতাসে সিস্টেম লস ছিল ২.৮১ ভাগ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা কমে ১.২৪ ভাগে নেমে এসেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads