• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
কয়লা নিয়ে হরিলুট

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি

সংরক্ষিত ছবি

অপরাধ

কয়লা নিয়ে হরিলুট

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কয়লা লুটপাট করা হয়

  • রেজাউল করিম লাবলু
  • প্রকাশিত ২৮ আগস্ট ২০১৮

কয়লা নিয়ে হরিলুট চলছে। দুর্নীতির আরো ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এই লুটপাটে। সরকারের শেষ সময়ে কিছু কামিয়ে নেওয়ার মানসিকতায় এসব করা হচ্ছে। এমনটাই মনে করেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা লুটপাট করা হয়েছে। এখন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা চলছে। এমনটা করা হলে দেশের অন্যতম শস্যভান্ডার উত্তরাঞ্চলের কৃষি জমি ধ্বংস হবে। এই সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। কোনোভাবেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না। এর চেয়ে কয়লা আমদানি দেশের ক্ষতি কম হবে।

গত ২২ জুলাই কয়লার অভাবে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক দিনাজপুরের ৫২৫ মেগাওয়াট  বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিরূপ প্রভাব পড়ে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে। এতে দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুতের লো-ভোল্টেজ ও ঘন ঘন লোডশেডিং চলছে। এ অবস্থার অবসানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত রোববার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, কয়লার অভাবে যাতে এভাবে আর বিদ্যুতের উৎপাদন বন্ধ না থাকে সেজন্য ‘বাফার স্টকের’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে এই বাফার স্টক তৈরি করা হবে।

তিনি বলেন, কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় দুটো তদন্ত রিপোর্ট তার হাতে রয়েছে। কারা জড়িত, কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। রিপোর্টের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। পুলিশ মামলা করেছে, দুদকও মামলা করেছে। এই তদন্ত রিপোর্টগুলো হয়তো মামলার জন্য সাপোর্টিভ হবে।

কয়লা লুটপাটে জড়িতদের নাম প্রকাশ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ-বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। গতকাল বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, খনির কয়লা লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি না দিয়ে বরং আরো দুর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। তাদের পাঠানো হয়েছে সিঙ্গাপুরে কয়লা আমদানির জন্য। কয়লা আমদানির নাম করে তারা কমিশন ভাগ-বাটোয়ারা করে খাবে।

তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, এতদিন যারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য চেষ্টা করে আসছিলেন দেশের সম্পদ ধ্বংস করে তাদের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি কুচক্রী মহল। এসব সেক্টরের দুর্নীতিবাজরা মনে করে দেশের মানুষ কিছু জানে না, বোঝে না। তারা সঙ্কট সৃষ্টি করে এটাকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে নতুন দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করছে।

আনু মুহাম্মদ বলেন, খনির কয়লা লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। সরকার তা না করলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা কমিটি গণতদন্ত কমিশন করে দুর্নীতিবাজদের খুঁজে বের করবে। তারপর গণআদালতের মাধ্যমে লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হবে। 

এদিকে প্রতিমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, আমদানি করা কয়লা এবং খনি থেকে নতুন করে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে অক্টোবরের শুরুতে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন পুরোদমে চালু করা যাবে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এমন আশা করলেও বিদ্যুৎ সচিব বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকা পরিদর্শন শেষে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে কয়লা উত্তোলন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর কথা বলেছেন। যদিও সেখানকার শ্রমিকরা বলেছে, তা সম্ভব নয়। আরো সময় লাগবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর বদরুল ইমাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এভাবে এত দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা সম্ভব হবে না। বড়পুকুরিয়ায় পর্যাপ্ত কয়লা মজুত আছে। সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করতে হবে। পাশাপাশি নতুন কূপ খনন করতে হবে। আমদানি করে এত বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, সরকারের শেষ সময়। এই সেক্টরে যেসব দুর্নীতিবাজ রয়েছেন তাদের কিছু কামাতে হবে এ আশায় তারা সঙ্কট তৈরি করেছে।

এদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি গতকাল বাংলাদেশের খবরকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি কুচক্রী মহল বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির লুটপাট করে একটি সঙ্কট তৈরি করেছে। এখন এই সঙ্কটকে পুঁজি করে কুচক্রী মহল উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কুচক্রী মহলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। কিন্তু উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না বড়পুকুরিয়া এলাকায়। কারণ ওই এলাকা বাংলাদেশের শস্যভান্ডার।

তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে দিনাজপুরসহ আশপাশের এলাকায় বিদ্যুতের সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বন্ধ হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সঙ্কট সৃষ্টির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সুযোগ সৃষ্টি করা। এমনটা করা যাবে না। করলে অতীতের মতো উত্তরাঞ্চলের মানুষকে নিয়ে আন্দোলন তৈরি করা হবে।

সাকি বলেন, দেশে দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী। শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক লুট, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুট, ভল্টের স্বর্ণ লুটের পর নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে কয়লা নিয়ে এমনটা করা হচ্ছে। অন্য মাত্রায় কুচক্রী মহল জনগণের সম্পদ লুটপাটের ব্যবস্থা করছে।    

১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দুটি ইউনিট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৬ সালেই এই দুটি কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে নতুনভাবে ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন তৃতীয় ইউনিট নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। নির্ধারিত সময়ের আগে প্রস্তুত কেন্দ্রটি থেকে লক্ষমাত্রার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। তৃতীয় এই কেন্দ্রের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ায় বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে সোয়া ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে ৩৯০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads