• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জমি দখল করে ‘নীলা মার্কেট

পূর্বাচলের ভোলানাথপুরে স্টেডিয়ামের জমি দখল করে গডে ওঠা নীলা মার্কেটের একাংশ

বাংলাদেশের খবর

অপরাধ

পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জমি দখল করে ‘নীলা মার্কেট’

# নেপথ্যে এমপি গাজী দস্তগীর # নীরব পূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রাজধানীর পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় স্টেডিয়ামের জন্য বরাদ্দকৃত হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে ‘নীলা মার্কেট’ গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকাশ্যে মার্কেটের সর্বেসর্বা রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার নাম থাকলেও এলাকাবাসী বলছেন, নেপথ্যের দখলদার আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) গাজী গোলাম দস্তগীর। ভয়ানক এ দখলবাজির ঘটনাড নীরব রয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। গোটা এলাকা এখন এমপি এবং তার সমর্থক দখলবাজদের নিয়ন্ত্রণে। এমপির বেআইনি কর্মকাণ্ডে সরকারের সিদ্ধান্ত অকার্যকর আর নিজ দলীয় নেতাকর্মীরাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। গাজীর সাম্রাজ্যে আইন-কানুন ও বিধিবিধানকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। সেখানে এমপি যা করেন যা বলেন, তা-ই আইন হয়ে দাঁড়ায়।

এলাকাবাসী জানান, নীলা মার্কেট মানেই ‘এমপি গাজীর লোকজনদের সাম্রাজ্য’। এ সাম্রাজ্যে গাড়ি পার্কিং পয়েন্ট, স্থায়ী-অস্থায়ী বাজার, কয়েকশ’ দোকানপাট, রেন্ট-এ কারের টার্মিনাল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মাছবাজার, মিষ্টির কারখানাসহ নানা অবকাঠামোর পসরা বসানো হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্তে পূর্বাচল আবাসন এলাকাকে ঘিরে পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলার জন্য সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, বিচারপতিসহ সব মহলকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আগামী প্রজন্মের কথা বিবেচনায় নিয়ে সেই প্রকল্পের বিশাল জায়গা স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু রূপগঞ্জের জায়গাজমি দখলের রেকর্ড স্থাপনকারী এমপি গাজীর নজর থেকে সেই স্টেডিয়ামের জায়গাটিও রক্ষা পায়নি। বিষয়টি অনেক মন্ত্রী ও ক্ষমতাধর অবহিত থাকলেও, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে পূর্বাচল স্টেডিয়ামের জায়গা দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না।

এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, সরকার ও প্রশাসনের চেয়েও কি একজন এমপির হাত এত লম্বা ও শক্তিশালী? গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক কেন স্টেডিয়ামের জায়গা জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তা দখলমুক্ত করছে না? এলাকাবাসী বলেন, সবারই জানা, এমনকি মন্ত্রীরাও জানেন, রূপগঞ্জে কেউ জায়গা কিনতে বা বিক্রি করতে চাইলে, বাড়িঘর নির্মাণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাইলে গাজী এমপির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা সম্ভব নয়। অনেক সময় এ নিয়ে একাধিক মন্ত্রীর দফতরে মীমাংসা বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, বরং দিনে দিনে আরো অবনতি হয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নীলা মার্কেটে রয়েছে কয়েকশ’ দোকানঘর। পাশেই ৫০০ দোকানের আলাদা কাঁচাবাজার গড়ে উঠেছে। এসব দোকানঘর থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার চাঁদা তোলা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিদিন বিদ্যুৎ, পানি ও পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে প্রতিটি দোকান থেকে আকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। মার্কেট ঘিরে ভোলানাথপুরসহ আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা। এসব আস্তানায় সহজেই পাওয়া যাচ্ছে মরণনেশা ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক। নীলা মার্কেটের আশপাশ নির্জন জায়গা। তাই শত শত তরুণ-তরুণী ঘুরতে এসে অসামাজিক কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত হয়ে পড়ছে। নীলা মার্কেটের সামনেই রয়েছে একটি কবরস্থান। এই কবরস্থানের ভেতরেই মাদকের মজুত গড়ে চলছে কেনাবেচা। বেশ কয়েকটি দোকানঘরের পজিশনও বিক্রি করা হয়েছে। একেকটি পজিশনের মূল্য এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা। এসব টাকা সংগ্রহ করেন নীলার স্বামী ফটিক আলম।

যেভাবে গড়ে ওঠে নীলা মার্কেট : পূর্বাচল আবাসনের ভোলানাথপুর এলাকায় বিশ্বমানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় রাজউক। এজন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা মূল্যের জায়গাও বরাদ্দ রাখা হয়। এ জমি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ দিলেও তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনো বুঝিয়ে দেয়নি রাজউক। ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা জায়গার ওপর নজর পড়ে প্রভাবশালী জবরদখলকারীদের। এমপি গোলাম দস্তগীরের পৃষ্ঠপোষকতায় ও রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর আগে সেখানে গড়ে তোলা হয় ক্লাবঘর। এর নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’। নীলার স্বামী ফটিক আলম ও দেবর আনোয়ার হোসেন এ ক্লাব পরিচালনা করেন। তাদের নেতৃত্বেই ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’ ঘেঁষে একের পর এক দোকানপাট গড়ে ওঠে, চলতে থাকে পজিশন আকারে জায়গা কেনাবেচা। দেখতে দেখতেই সেখানে ৭০০ থেকে ৮০০ দোকানের বিরাট বাজার জমে উঠেছে। নীলার নামেই অবৈধ এ বাজারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নীলা মার্কেট’। সেখানে একেকটি দোকানের পজিশন মূল্য বাবদ তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা এককালীন আদায়ের পাশাপাশি ভাড়ার নামে দোকানপ্রতি দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

রাজউক সূত্র বলেছে, অবৈধভাবে গড়ে তোলা নীলা মার্কেটটিতে অন্তত চার দফা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই উচ্ছেদ শেষে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবারো সেখানে দোকানপাট নির্মিত হয়। এরপরও একাধিকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও পুলিশের সহায়তার অভাবে সফল করা যায়নি। পূর্বাচল উপশহর গড়ে ওঠার লক্ষ্যে ভোলানাথপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তাঘাট সুন্দর করে নির্মাণ হয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ ফুট সড়কের আশপাশের এলাকাগুলো অতি নির্জন। এজন্য বিভিন্ন স্থান থেকেই মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। তাদের টার্গেট করেই নীলা মার্কেট ও আশপাশ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে মাদকের আস্তানা। বসানো হয়েছে হরেকরকম জুয়ার আসর। নারীকেন্দ্রিক নানারকম অপরাধ আখড়াও জমে উঠেছে সেখানে। র্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের চোখের সামনে জবরদখলসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড চললেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। মাদকের খোলাহাট হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পাওয়া নীলা মার্কেটে সব ধরনের মাদকের রমরমা বাণিজ্য পরিচালনা করেন আনোয়ার হোসেন। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সালাউদ্দিন, বাকির, রাসেল, নূরুজ্জামান, রাকিব, মোমেন, বাসিত, আবুসহ ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ মাদক বিক্রি ছাড়াও খদ্দেরদের জন্য নিরাপদে সেবনের জায়গার ব্যবস্থা করে দেন।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা বলেন, এমপি সাহেবের নির্দেশে স্টেডিয়ামের জায়গায় এ অস্থায়ী বাজার বসানো হয়েছে। আবাসন প্রকল্পের কারণে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন তাদের উৎপাদিত ফল-ফসলাদি এ বাজারে বেচাকেনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাজার ঘিরে চাঁদাবাজি চালানোর অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া : গাজী গোলাম দস্তগীর এমপির নেতৃত্বে পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জায়গা জবরদখলসহ রূপগঞ্জের সর্বত্র দখলবাজির ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, পূর্বাচল প্রকল্পের স্টেডিয়াম জবরদখল করে নীলা মার্কেট বসানোর অপকর্মের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল বা এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নেই। এটা গাজী এমপি ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ব্যক্তিগত লুটপাটের ব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখানে জবরদখলের মার্কেট বানানোর নামে মাদক, জুয়া, অসামাজিক কার্যকলাপের বিশাল আখড়া গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি অবিলম্বে স্টেডিয়ামের জমি দখল করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা নীলা মার্কেট উচ্ছেদপূর্বক নির্ধারিত স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজ শুরু করার দাবি জানানা।

রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি খন্দকার আবুল বাসার টুকু বলেছেন, এমপির নেপথ্য ইন্ধনে তারই ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফেরদৌসী আলম নীলার নামে জবরদখলবাজির এ মার্কেট তৈরি হয়েছে। এমপি, তার পিএস, এপিএস আর নীলা এ মার্কেট গড়ার নামে সীমাহীন চাঁদাবাজি ও লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীর বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই। রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হারেজ বলেন, অবৈধ নীলা মার্কেট ঘিরে জঘন্য মাত্রার যে অপরাধ অপকর্ম চলছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সেখানে মদ, জুয়া, দেহবাণিজ্যের সীমাহীন বেলেল্লাপনা চলছে। অথচ নেপথ্যে এমপির হাত থাকায় অপরাধ অপকর্মের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার উপায় নেই।

রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান সজীব বলেন, এমপি গাজী গোলাম দস্তগীর তার নিজস্ব বলয়ের গুটিকয়েক লোক নিয়ে আওয়ামী লীগের বিকল্প ‘গাজী লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমপির নেতৃত্বে রূপগঞ্জজুড়েই জবরদখল, লুটপাট ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এর ধারাবাহিকতাতেই তিনি ও তার সহযোগীরা রাজউকের হাজার কোটি টাকার সম্পদ গিলে খাওয়ার মতলবে গড়ে তুলেছেন অবৈধ নীলা মার্কেট।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য মিজানুর রহমান মিজান, উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক শায়লা তাহসীন সিথী, দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর, রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হোসেন ভূঁইয়া রানুসহ স্থানয়ী নেতাকর্মীরা অবিলম্বে অবৈধ নীলা মার্কেট উচ্ছেদ করে পরিকল্পনা অনুযায়ী স্টেডিয়াম নির্মাণের জোর দাবি জানান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads