• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
রাজধানীতে বেড়েছে নীরব চাঁদাবাজি

রাজধানীতে এভাবেই চলছে নীরব চাঁদাবাজি

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

রাজধানীতে বেড়েছে নীরব চাঁদাবাজি

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ২১ অক্টোবর ২০১৮

নির্বাচন সামনে রেখে নীরব চাঁদাবাজি বেড়েছে রাজধানীতে। এ চাঁদাবাজি ফুটপাথ থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অফিস পর্যন্ত বিস্তৃত। পেশাদার চাঁদাবাজদের পাশাপাশি এ কাজে যুক্ত আছে পুলিশ বাহিনীর অসাধু সদস্যরাও। কোথাও নতুন ভবন নির্মাণ করতে গেলে লোক পাঠিয়ে আসে ক্ষমতাসীন দলনেতার ফোনও। আবার দেশের বাইরে বসে মোবাইল ফোনে একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী সহযোগীদের মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সেই দলের লোকজন এবং পুলিশ-সন্ত্রাসীর সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি নেই সাধারণ ব্যবসায়ীদের। ব্যবসার স্বার্থে, জীবনের ভয়ে চাঁদাটা তাদের নিয়মিত দিয়ে যেতেই হয়। ব্যাপক অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, লাইনম্যান নামধারী এক শ্রেণির দালাল ফুটপাথের হকারদের কাছে থেকে চাঁদা তোলে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন ও এর আশপাশের এলাকার ফুটপাথে এ চাঁদার পরিমাণ মাসে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা। অবশ্য এই চাঁদাবাজি বন্ধে এই প্রথম দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ৭২ জন চাঁদাবাজকে চিহ্নিত করে মামলা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মতিঝিল থানা পুলিশ একটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেছে আদালতে। ওই অভিযোগপত্রে মাত্র ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এসব আসামি এখনো ফুটপাথে চাঁদাবাজি করছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব চাঁদাবাজকে আশ্রয় দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। শুধু তা-ই নয়, লাইনম্যান কার্যত থানা পুলিশেরই নিয়োগ করা। পুলিশ নিজেরা চাঁদা না তুলে লাইনম্যান দিয়ে ফুটপাথের হকারদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে নগদ অর্থ সংগ্রহ করে।

আরেক ধরনের চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও স্বনামধন্য ব্যবসায়ীরা। নেপালে পালিয়ে থাকা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত তার বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে মিরপুর, পল্লবী, দারুস সালাম, ভাষানটেক, কাফরুল ও আশপাশ এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করে থাকে। এসব এলাকা থেকে শাহাদাতের মাসিক আয় কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা। চাঁদার টাকার ৬০ ভাগই পাঠানো হয় শাহাদাতের কাছে। বাকি ৪০ ভাগ সহযোগীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় মিরপুরে শাহাদাত বাহিনীর হাতে গত ১০ বছরে তিন ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে আরো পাঁচজনকে। জীবনহানি বা অঙ্গহানির ভয়ে ব্যবসায়ীরা এখন আর শাহাদাতকে ঘাঁটায় না। তারা নীরবে চাঁদা দেওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করে। একই চিত্র পুরান ঢাকার আর্শ্বিন গেট, আইজি গেট, শ্যামপুর, ফরিদাবাদ, মিলব্যারাক ও আশপাশ এলাকার। এলাকাটি তালিকাভুক্ত আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ভারতে অবস্থানরত কচির নিয়ন্ত্রণাধীন। সে দেশের বাইরে পলাতক থাকলেও তার বাহিনীর কমপক্ষে এক ডজন সদস্য সক্রিয় আছে। তারাই কচির পক্ষ থেকে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে। কচি শুধু ব্যবসায়ীদের ফোন করে। কচির ফোন পেয়ে ব্যবসায়ীরা নীরবে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। না দিলে এলাকায় ব্যবসা করা যাবে না। এমনকি প্রাণটাও যেতে পারে। কোথাও অভিযোগ করলেও বিপদ হতে পারে আশঙ্কায় কেউ কোনো অভিযোাগ করেন না।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া মুঠোফোনে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এসব ঘটনার সত্যতা আছে কি না, সেটা নিয়েই আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ এসব ডায়ালগবাজি মার্কা কথা প্রায়ই শুনি। তার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। এমনও হয়েছে লোকমুখে শুনে বা মিডিয়ার প্রকাশ বা প্রচার হওয়ার পর খবর নিয়ে দেখি, সে রকম কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেনি। যাকে ভিকটিম বলা হচ্ছে, তিনিই ঘটনা অস্বীকার করছেন। তিনি আরো বলেন, এসব ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না করলে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। কাউকে না কাউকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সোর্স গোপন রাখব।

পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এখন নতুন শব্দ বেরিয়েছে ‘নীরব চাঁদাবাজি’। ঢাকা মহানগরীর মানুষ অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে ভালো আছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ বর্তমান সরকার নগরবাসীর জানমালের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে নগরীতে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিংসহ সব ধরনের অপরাধ কমে গেছে। এখন মানুষ স্বস্তিতে আছে। বরং পুলিশি সেবার মান বাড়ায় পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা দিন দিন বাড়ছে।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চাঁদাবাজির কথা। তিনি বলেন, স্থানীয় যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের টার্গেট এ মৌলভীবাজার, ঈদ-পূজা, দলীয় অনুষ্ঠান নানা অজুহাতে চাঁদার আবদার। না দিলে ট্রাক থেকে মাল নামাতে দেবে না। এদের ব্যাপারে কোথাও অভিযোগ করেও লাভ নেই। তাই আমরা নীরবেই চাঁদা দিই।

এ ছাড়া সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে নগরজুড়েই ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারা আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখন সন্ত্রাসীরা নয়, কোথাও কোনো নতুন ভবন নির্মাণ করতে গেলেই স্থানীয় নেতারা হাজির হন মোটা অঙ্কের চাঁদার জন্য। না দিলে কাজ বন্ধ। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। সূত্রমতে, ওই নেতা কাকরাইলস্থ আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম কার্যালয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। এতে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিষয়টি লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানানো হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ওই নেতা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম কার্যালয় থেকে চাঁদা চাওয়া থেকে নিবৃত্ত হন।

এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার টেম্পু ও হিউম্যান হলার থেকেও চাঁদা নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের চিহ্নিত নেতারা। স্থানভেদে যাত্রীপরিবহনের জন্য এসব যান থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেম্পু বা হিউম্যান হলার থেকে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি করা হয়, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, বাড্ডার শাহজাদপুর, ফার্মগেট, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, জুরাইন রেলগেট, নিউমার্কেট, আজিমপুর, নিউ পল্টন, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর মাজার রোড, উত্তরখান, দক্ষিণখান এলাকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা রুটে চলাচলকারী টেম্পু ও হিউম্যান হলার থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলেন বাচ্চু খন্দকার। একসময় ফ্রিডম পার্টির নেতা বাচ্চু এখন সরকার সমর্থিত শ্রমিক লীগ নেতা।

একই রুটের গাড়ি থেকে চাঁদা তোলে কাউয়া খালেক ও সোহরাব। যাত্রাবাড়ী পাইকারি আড়তে চাঁদাবাজি করে বকুল ও রিপন। এখানকার ফুটপাথের চাঁদা তোলে সোনা মিয়া। ফার্মগেটে চাঁদা ওঠে যুবলীগের এক নেতার নামে। শনিরআখড়া থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলাচলকারী টেম্পুগুলো থেকে চাঁদা তোলে স্থানীয় যুবলীগ নেতার লোকজন। জুরাইন রেলগেটেও চাঁদাবাজি করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফুলবাড়িয়া, কাপ্তানবাজার, গুলিস্তান এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা।

এ ছাড়া রাজধানীতে অবৈধভাবে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত প্রায় এক লাখ ইজিবাইক ও রিকশা থেকেও চাঁদা তোলা হচ্ছে। প্রতিটি চাঁদার নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads