• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
আর কত পাশবিকতা

সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে গুরুতর আহত করেছে তার পাষণ্ড স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

অপরাধ

আর কত পাশবিকতা

# বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়াচ্ছে সহিংসতা # সিগারেটের ছ্যাঁকা ও চুল কেটে নির্যাতন

  • তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ১১ জানুয়ারি ২০১৯

বাবা ভ্যানগাড়ি চালান। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এর মধ্যে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে চেয়ে পাঠানো যৌতুকের টাকা দিতে পারেননি তিনি। সেই অপারগতার কারণেই মেয়ে সাথী আক্তারের ওপর নেমে এলো পাশবিক নির্যাতন। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে এই গৃহিণীকে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে গুরুতর আহত করেছে তার পাষণ্ড স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা। কেটে ফেলা হয়েছে সাথীর মাথার চুলও। গুরুতর আহত সাথীকে ভর্তি করা হয়েছে স্থানীয় হাসপাতালে। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল বৃহস্পতিবার। এ ঘটনায় সাথী স্বামী, দেবর, শ্বশুর, শাশুড়িসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগও করেছেন। কিন্তু বিচার পাবেন সে আশায় বুক বাঁধতে পারছেন না অসহায় এই নারী।

সাথীর অভিযোগ, চার বছর আগে হরগাতি গ্রামের আলী আকবর হাওলাদারের ছেলে রিয়াজুলের (৩০) সঙ্গে বিয়ে হয় তার। এ পর্যন্ত স্বামী রিয়াজুলকে ৯০ হাজার টাকা দিয়েছেন সাথী। কিন্তু আরো দেড় লাখ টাকা দাবি করছে রিয়াজুল। সাথীর বাবা বেল্লাল খান ওই টাকা দিতে না পারায় তার ওপর নেমে আসে এই নির্যাতন।

শুধু সাথী নয়, দেশের হাজার হাজার নারী প্রতিবছরই এমন নির্যাতনের শিকার হন। পারিবারিক সহিংসতার পাশাপাশি শিকার হন ধর্ষণ ও অঙ্গহানির। বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর বা শিশুর প্রতি সহিংসতার যথাযথ বিচার না হওয়ার কারণে প্রতিবছরই এমন ঘটনা ঘটে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই নারী-শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে।

২০১৯ সালের শুরুর দিন থেকে প্রতিদিনই এক বা একাধিক ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে পত্রিকার পাতা উল্টালেই। বছরের প্রথম দশ দিনেই ১৫টির বেশি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি। গতকাল আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৮ : আসকের পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩২ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণপরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন।

অন্যদিকে ২০১৮ সালে শিশু নির্যাতন ও হত্যা বেড়েছে। এ বছর বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় মোট ১ হাজার ১১ জন শিশু। তার মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পর মৃত্যু, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ২৮৩ জন নিহত হয়েছে। আত্মহত্যা করে ১০৮ জন, রহস্যজনক মৃত্যু হয় ২৮ জনের এবং যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৪ জন শিশু।

২০১৮ সালে বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৭৩ জন। যার মধ্যে ১১৬ জন নারী। উত্ত্যক্ত করার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন নারীসহ খুন হয়েছেন ১২ জন। সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাছাড়া যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৯৫ জন। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৮৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন।

অন্যদিকে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪০৯ জন। এছাড়া ৫৮ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ নারী, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২৬ নারী এবং নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে মারা যান ১৮ জন। অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হন ২২ জন। এর মধ্যে একজন মারা যান।

এ বিষয়ে আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা এক পরিসংখ্যানের বরাতে বলেন, ৭৩ শতাংশ বিবাহিত নারী তাদের স্বামীর দ্বারা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এদের মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ নির্যাতনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন। আর ৩৫ শতাংশ অবিবাহিত নারী পুরুষের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, যাদের মাত্র ৩ শতাংশ নির্যাতনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন।

তিনি বলেন, জেন্ডারবেইজড ভায়োলেন্সের প্রধান দিক হচ্ছে নারীকে ছোট করে দেখা। নারী তার চেয়ে দুর্বল এই প্রবণতা থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতা হয়ে থাকে। দেশে প্রতি পাঁচজন বিবাহিত নারীর তিনজনই সহিংসতার শিকার হন।

শীপা হাফিজা বলেন, এই ধর্ষণ, নির্যাতন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা জানতে চাই না একজন ধর্ষণকারী, একজন অপরাধী কোন দলের, কোন মতের? কতটা ক্ষমতাধর সে? বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক এবং নারী হিসেবে আমরা এই ধর্ষণের রাজনীতির অবসান চাই।

তবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম বলেন, সরকার নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে তৎপর। ৯৯৯ জাতীয় হেল্পলাইন নম্বরের সঙ্গে ১০৯ নম্বরও আছে। যেখানে নারীরা নির্যাতনের অভিযোগ করতে পারেন। তিনি বলেন, একা কেউ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের সহযোগিতা দরকার। আমরা যে কাজগুলো করছি, তা বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে করলে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারব। নারী-পুরুষ একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads