• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ভারী হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস

আইজিপি মো. সোহেল রানা, অ্যাড. সালমা আলী ও ড. জিয়া রহমান

ছবি : সংগৃহীত

অপরাধ

ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি বাড়ছেই

ভারী হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

শত আর্তনাদ শব্দহীন হয়ে ডুবে যাচ্ছে চোখের জলে। সম্মান, সম্ভ্রম আর কুসংস্কারের নানান সামাজিক অনুশাসন ঢেকে রাখছে বেদনাবিধুর হাজারো ক্ষত। আমৃত্যু সঙ্গী হচ্ছে নির্যাতনের কালো কষ্টের দীর্ঘশ্বাস।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক নারী ও শিশুর ওপর ঘটছে ধর্ষণ আর পাশবিকতার ঘটনা। ধর্ষণের পর হত্যার প্রবণতাও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। সরকারের নানান উদ্যোগেও থামছে না এসব পাশবিকতা। সুবর্ণচরের গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনা সম্প্রতি আলোচিত হলেও প্রতিদিন এমন অনেক ঘটনাই থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে।

সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু আইনের ওপর ভর করে বসে থাকলে চলবে না। নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তা ছাড়া অপরাধী যাতে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে সেদিকে কঠোর হতে হবে।

বনানীর রেইনট্রি আবাসিক হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অভিযুক্ত পাঁচজনের মধ্যে মামলার মূল আসামিসহ চারজনই এখন জামিনে মুক্ত। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের গৃহবধূ ধর্ষণ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই খোদ রাজধানীর ডেমরায় দুই শিশুকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গোলাম মোস্তফা ও আজিজুল নামের দুজনকে আসামি করে শিশু দুটির বাবা মামলা করেন। এরপরই পুলিশ হত্যারহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে এবং আসামিদেরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। আসামিরা শ্বাসরোধে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। এ ছাড়া ফরিদপুরে দুই বোনের শ্লীলতাহানির ঘটনা সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হলে পুলিশ অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনে।

আবার রাজধানীর ৫৫/৩ কাকরাইল আনন্দ ভবনে অসহায়-অনাথ শিশু পপি আক্তারকে (১০) গত দেড় বছর ধরে বাসায় কাজের নামে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তার বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রোয়াচালা গ্রামে। গৃহকর্তা  আলমগীর ও তার স্ত্রী হ্যাপী আক্তার শিশু পপিকে বাসায় আটকে রেখে ভারী কাজ করানোর পাশাপাশি শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। সম্প্রতি শিশুটিকে পুলিশ ওই বাসা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। গত সপ্তাহে ঢাকার সাভার উপজেলায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের পর মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হলে ওই তরুণী (২১) নদীতে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গত রোববার রাতে এ ঘটনা ঘটে। একই উপজেলায় গত বৃহস্পতিবার রাতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এক কিশোরীকে (১৬) ঘরে আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নরসিংদীর সদর উপজেলায় গত সোমবার দুপুরে দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী (৭) ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পরিবার। তার মা বলেন, মেয়েটি দুপুরে উঠানে খেলার সময় উত্তম দাস নামে এক ব্যক্তি তার মুখ চেপে ধরে নিজ বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে। বাড়ি ফিরে মেয়ে তাকে বিষয়টি জানায়। ধর্ষিত ওই শিশুকে নরসিংদী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় তার বাবা থানায় মামলা করেছেন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১৪ জানুয়ারি রাতে ফুফুর বাড়িতে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী (৯) ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগে তার বাবা রোববার রাতে শিশুর ফুফাকে আসামি করে শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা করেছেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারার একটি গ্রামে শনিবার বিকালে বাড়ির উঠানে খেলার সময় এক শিশুকে বিস্কুট কিনে দেওয়ার কথা বলে পুকুরপাড়ে নিয়ে ধর্ষণ করে তার প্রতিবেশী চাচা (১৯)। এ ঘটনায় রোববার রাতে মামলা করেন শিশুটির মা।

ধর্ষণ, নির্যাতন ও পাশবিকতার এসব বিষয়ে এআইজি মিডিয়া মো. সোহেল রানা বলেন- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় জামিন পাওয়া সহজ নয় বলে অনেকে এর অপব্যবহার করছে। যারা মিথ্যা মামলা দেয় তাদের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি বড় সুবিধা হলো যে, এই আইনে জামিন পেতে বেগ পেতে হয়। আগে আইনটি জামিন অযোগ্য ছিল। এখন কিছু ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া যায়। মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে আসামিকে জেলে থাকতে হয়, না হয় অনেকে পালিয়ে থাকে। জামিন কঠিন হওয়ায় অনেকে এর অপব্যবহার করছে। খুব দ্রুততম সময়ে এই মামলায় হয়রানি করার একটা সুযোগ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, এই মামলা খুব দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে হয়, ৯০ দিনের মধ্যে। এজন্য মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। মামলা করার পর প্রতিপক্ষ যে একটা চাপে থাকে, হেনস্তা হয়, সে কারণে যাদের সঙ্গে বিবাদ তারা হয়তো আপস করে ফেলে।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, প্রাথমিকভাবে এ জাতীয় মামলা সিরিয়াস হলেও পরবর্তী কিছুদিন পরে আসামি কোনো না কোনোভাবে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর নির্যাতিতাকে ভয় দেখানো, মামলা তুলে নেওয়ার চাপ দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে থাকে। এ ধরনের মামলায় আসামির বেল পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে আসামি কোনো না কোনোভাবে জামিন পেয়ে যায়। প্রথমত, অধিকাংশ বাদীই মামলা করার কিছুদিন পর ওই মামলার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। যার জন্য মামলার ধীরগতিই দায়ী। তাই এ জাতীয় মামলা নির্দিষ্ট কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হয়। ১৫ দিনের মধ্যে পুলিশের চার্জশিট প্রদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। এ ছাড়া মামলার নিয়মিত নজরদারি ও একই সঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে। মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ, ডাক্তার, ভিকটিম, সাক্ষী, আইনজীবী ও বিচারক সবাইকে পজিটিভ হতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এ বিষয়ে সরকারকে সবচেয়ে বেশি আন্তরিক হতে হবে।

বিচারের মেয়াদ : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত আইন ২০১৩ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার কথা। ট্রাইব্যুনাল যদি ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হন, তাহলে কারণ সংবলিত একটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করবেন। যার একটি অনুলিপি সরকারকেও দিতে হবে। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে কারণ উল্লেখপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এ রকম দাখিলকৃত প্রতিবেদনগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই আইন অনুযায়ী পুলিশ যদি অভিযোগ গ্রহণ না করে সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি বিচারের জন্য অভিযোগ আনতে পারেন। এই বিধানটি যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়, তবে জনগণের অভিযোগ করা অনেক সহজ হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নতুন সরকারকে এই বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতাও বাড়ানো দরকার। মানুষের মধ্যে পাশবিকতা বাড়ছে। কতটা বিকৃত মানসিকতা হলে ৪-৫ বছরের অবুঝ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করতে পারে। এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে, এর কারণ হচ্ছে অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যায়। অভিযোগের পর যিনি তদন্ত করেন, যিনি মেডিকেল চেকআপ সম্পন্ন করেন এবং যারা আদালতে দায়িত্ব পালন করেন সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে কমিটমেন্ট নিয়ে কাজ করতে হবে। যেভাবে চলছে এতে হচ্ছে না। এখন সময় এসেছে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads