ইয়াবা আসা বন্ধ হয়নি। আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্রের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলাদেশে ইয়াবা কারবারির এই মরণ নেশা চলছেই। প্যামেন্ট আসছে কখনো ভারত আবার কখনো মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর থেকে। অতি মুনাফার কারণে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক চোরাকারবারিরা। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা মাদক মাফিয়াদের দোসরদের কারণেও মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রবেশের প্রধান রুট কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে কমে এসেছে ইয়াবার চালান। কিন্তু তাতেও কোনো ঘাটতি নেই মরণ নেশা ইয়াবার। ইতোমধ্যে নতুন নতুন রুট দিয়ে ইয়াবা আসতে শুরু করায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেও টেকনাফ দিয়ে প্রচুর ইয়াবা প্রবেশ করত। কিন্তু সম্প্রতি ১০২ গডফাদার পুলিশের সেফ হোমে যাওয়ার পর থেকে নতুন রুট খুঁজতে শুরু করে ইয়াবা কারবারিরা। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় জেলে ও রোহিঙ্গাদের প্রধান বাহক বানিয়ে ইয়াবার চালান আনছে তারা। মাদক চোরাকারবারিরা সমুদ্রপথকে বেছে নিয়েছে ইয়াবা চালানের নতুন রুট হিসেবে। কারো কারো পেট ভাড়া করে ইয়াবা আনছে। ইয়াবার প্যাকেট স্কচটেপ দিয়ে মুড়িয়ে তাতে মবিল মেখে মলদ্বার দিয়ে পেটের ভেতর ঢোকানো হয়। এক্ষেত্রে পেটের ভেতর ওই প্যাকেট ফেটে গিয়ে বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত ১ হাজার ১৫১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে যারা গডফাদার ছিল তাদের বেশির ভাগই পলাতক রয়েছে। সম্প্রতি যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের অধিকাংশ টেকনাফের ব্যবসায়ী। কিন্তু উখিয়া ও কক্সবাজারের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারাই অর্থলগ্নি করে ইয়াবা ব্যবসা সচল রেখেছে বলে দাবি করেছে বিভিন্ন সূত্র। এ জন্য রোহিঙ্গা ও জেলেদের বেছে নেওয়া হচ্ছে। তারাই আয়েশি জীবনের আশায় দেশে ইয়াবা আনছে। যে কারণে বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগেরই নাম জানে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আত্মসমর্পণকারীদের স্বীকারোক্তিতে পাওয়া আরো দেড়শ জন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা গেলে ইয়াবার দৌরাত্ম্য কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, কক্সবাজারের সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে আমরা নিরাপত্তা জোরদার করেছি। এই পথে ইয়াবা আনতে না পেরে মাদক ব্যবসায়ীরা নৌপথকে বেছে নিয়েছে। নৌপথে কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ সদস্যরা চেষ্টা করছে সমুদ্রপথে ইয়াবার চালান আসা রোধ করার জন্য। তিনি আরো বলেন, আমি এখানে যোগদান করার পরই ইয়াবার বিরুদ্ধে ‘ক্রুশেড’ ঘোষণা করেছি। পুলিশ বাহিনীর চিহ্নিত সদস্যদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকা বা সহায়তা করার অভিযোগ পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধেই কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুশিয়ার করে দিয়েছি।
সূত্রমতে, টেকনাফের পর উখিয়া উপজেলার থাইংখালী রহমতের বিল, পালংখালী, বালুখালী এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তকে ইয়াবা পাচারের রুট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গভীর সমদ্রপথে জেলেদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে ইয়াবার চালান। ইয়াবা পাচারে আগে নাফ নদী ব্যবহার হলেও বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকাসহ ১২ থেকে ১৫টি রুট ব্যবহার করছে ইয়াবা কারবারিরা।
বিজিবির একটি সূত্র জানায়, মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় ৪৯টি ইয়াবার কারখানা রয়েছে। কারখানার মালিকরা ওখানকার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় ইয়াবার চালান পৌঁছে দিচ্ছে মাছ ধরার নৌকায়। মূলত গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার আড়ালে অদলবদল হয় ইয়াবা। হোয়াইকং থেকে শেমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার জেলে বাস করে। বর্তমানে এদেরই একটি অংশ বাহক হিসেবে কাজ করছে বলে জানা গেছে। তাদের সঙ্গে ভিড়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ।
জানতে চাইলে টেকনাফ বিজিবি-২-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আছাদুদ-জামান চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যে এলাকার বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের পেশা হিসেবে ইয়াবাকে বেছে নেয় তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় টেকনাফে ইয়াবা কমে এসেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বসে নেই। রুট পাল্টে তার এখন নতুন পথে ইয়াবা আনার চেষ্টা করছে। যেহেতু নানা সীমাবদ্ধতায় গভীর সমুদ্র ও সীমান্তে শতভাগ নজরদারি করা সম্ভব হয় না, সে সুযোগটা তারা নেওয়ার চেষ্টা করবেই। তবে আমরাও সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আশা করি ইয়াবা নির্মূল হবেই।