• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ভুল আসামির কারাবাস বাড়ছে

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

ভুল আসামির কারাবাস বাড়ছে

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ০৮ মে ২০১৯

প্রকৃত আসামি একজন, অথচ সাজা খাটতে হচ্ছে অন্যজনকে। অপরাধী না হয়েও অন্যের অপরাধের সাজা ভোগ করতে হচ্ছে নিরীহ ব্যক্তিদের। কখনো নাম একই হওয়ায়, চেহারায় মিল থাকায় ও পুলিশের ভুলে এমন ‘আসামিরা’ কারাবাস করছেন। পুলিশের অসতর্কতা, যাচাই-বাছাইয়ে অনীহা ও প্রভাবশালীদের ষড়যন্ত্রের কারণে অপরাধ না করেও অনেকে দিনের পর দিন ও বছরের পর বছর কারাগারে কাটাচ্ছেন। কখনো কখনো সরকারি অসৎ কর্মকর্তারা নিজের অপকীর্তি আড়াল করতে ভুল ব্যক্তিকে আসামি হিসেবে দাবি করে পুলিশ ও আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠছে। এসব ঘটনা দেশ ও বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করছে। তবু একের পর এক ঘটনা ঘটছেই সারা দেশে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তদন্তের মাধ্যমে যাচাই শেষে বিভিন্ন মামলার আসামির নাম ও ঠিকানা নিশ্চিত করেন পুলিশ। কিন্তু স্লিপে অনেক সময় আসামির ছবি যুক্ত না থাকার সুযোগ নিয়ে অনেক অভিযুক্তই নিজের নাম ও ঠিকানা ভুল দিচ্ছেন। মামলার বিচারে আসামির সাজা হলেও সেই সাজা ভোগ করতে হচ্ছে অন্যজনকে। অন্যের সাজা ভোগ করতে গিয়ে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক নানা ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অন্যের মামলায় কারাগারে থাকায় পরিবারটিতে বিপর্যয় নেমে আসছে। ভুক্তভোগীদের ভাগ্যে কোনো ক্ষতিপূরণ মিলছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ারও কোনো বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, যে কোনো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আসামি গ্রেফতারের আগে আরো সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি যাচাই-বাছাই করা উচিত।

তথ্যমতে, সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২৬ মামলার ভুল আসামি পাটকল শ্রমিক জাহালম প্রায় তিন বছর কারাভোগের পর ঘটনাটি সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নজরে আনার পর মুক্তি পান। এ ঘটনা দেশ ও বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় গত ১৮ এপ্রিল এরকম আরেক জাহালমের ঘটনা প্রকাশিত হয়। মাদক মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত শাহাবুদ্দিন বিহারির পরিবর্তে আসামি হিসেবে তিন বছর ধরে কারাগারে আছেন ‘নির্দোষ’ আরমান। আরেকজনের দণ্ডে জেল খাটা ঢাকার পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমানের মামলার নথি তলব করেন উচ্চ আদালত। আদেশের অনুলিপি পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগর দায়রা জজকে উচ্চ আদালতে নথি দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০১৫ সালে পোশাককর্মী জোয়েনা খাতুনকে হত্যার অভিযোগে ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানার মামলায় পুলিশ প্রথমে মূল আসামি ‘আবদুল রাজ্জাক’ নামের এক গাড়িচালককে গ্রেফতার করে। মাস তিনেক পর ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর জামিনে বের হয়ে যান তিনি। এরপর ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ আবদুল রাজ্জাক হিসেবে রংপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় ‘আবদুর রাজ্জাক’ নামের আরেক ব্যক্তিকে। নামের মিল থাকায় আবদুর রাজ্জাক আসামি না হয়েও এখন কারাগারে আছেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মূল ব্যক্তির বদলে অন্য কেউ, বা ভুল আসামি কারাগারে আছেন বলে প্রশ্ন উঠলে কারাগারে আটক ব্যক্তি আদালতের কাছে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর তদন্তের আবেদন করতে পারেন। আবেদনে সন্তুষ্ট হলে আদালত অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।’

যশোর শহরতলির খোলাডাঙ্গার সবুজ বিশ্বাসকে পুলিশ জনি নামে আটক করে আদালতে সোপর্দ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার বেড়বাড়ি গ্রামের মিঠু শেখ হত্যা মামলার আসামি পলাতক জনির গ্রেফতারি পরোয়ানায় কোতোয়ালি থানার এএসআই সোহেল রানা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সবুজকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠান। সবুজ বিশ্বাসের পরিবারের দাবি, তিনি জনি নন। সবুজের আইনজীবী মোস্তফা হুমায়ুন কবির মুঠোফোনে বাংলাদেশের খবরকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সবুজ যে জনি নন, এর প্রমাণ হিসেবে আদালতে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিয়েছি।’

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিদ্যুৎ সংযোগ না দিয়েও উল্টো ‘বকেয়া বিল না দেওয়ার অপরাধে’ আবদুল মতিন নামে এক দিনমজুরকে গত ১৭ এপ্রিল গ্রেফতার করে কুমিল্লা কারাগারে পাঠায় মুরাদনগর থানা পুলিশ। বিষয়টি জানাজানি হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে ১৯ এপ্রিল মতিন কারাগার থেকে মুক্তি পান।

ময়মনসিংহের ভালুকায় গ্রাহক না হয়েও পল্লী বিদ্যুতের মামলায় হাজতবাস করতে হয় জালাল উদ্দিন মণ্ডল নামের এক নিরীহ কৃষককে। গত ১৮ এপ্রিল রাতে বিরুনীয়া গ্রামের জালাল উদ্দিনকে নিজ বাড়ি থেকে পুলিশ অন্যের মামলার ভুল আসামি হিসেবে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়। তিন দিন বিনা অপরাধে তিনি হাজতে থাকার পর এক হাজার টাকা মুচলেকা দিয়ে জামিনে ছাড়া পান।

ঢাকার শাহবাগ থানার মাদকের একটি মামলার আসামি না হয়েও পুলিশের ভুলে ১১ মাস কারাভোগ করেন শুক্কুর শাহ নামের নিরীহ এক ব্যক্তি। প্রায় এক বছর জেল খেটে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মুক্তি পান। মামলার ঘটনা সূত্রে উল্লেখ আছে, শাহবাগ থানার একটি মামলার মূল আসামি ২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি এ মামলায় জামিন পান। জামিন পেয়ে শুক্কুর আলী এ মামলায় হাজিরা না দিয়ে পলাতক হন। ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এরপর এক পর্যায়ে গ্রেফতার হন শুক্কুর শাহ।

যশোরে মাদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত শিরিন বেগমের বদলে আরেক নারী রেখা খাতুনের সাজা খাটার ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশিত হয়। পুলিশের ভুলে নিরপরাধ এক নারী সাজা খাটার বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় পর গত ৪ এপ্রিলের মধ্যে সব প্রমাণ দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।

গত বছর চট্টগ্রামের সদরঘাট থানার অস্ত্র মামলায় দণ্ডিত হিসেবে ভুল আসামি অমর দাস নামের এক ব্যক্তির কারাবাসের কথা জানাজানি হলেও সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে। এর আগে ২০০৭ সালে কক্সবাজার জেলায় অপরাধ না করে দণ্ডিত হয়ে অন্যের মামলায় কারাগারে যেতে হয় এক প্রবাসী দম্পতিকে। ওই দম্পতি পরে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হলে দীর্ঘ কারাভোগ শেষে জামিনে মুক্তি পান। শুধু নামে মিল থাকায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার বেপারীপাড়ার পাশের হাটখোলাপাড়া এলাকার সামসুল হকের ছেলে জাকির হোসেনকে ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তিনি প্রকৃত জাকিরের দণ্ড ভোগ করে ২০১২ সালে মুক্তি পান। ২০১৭ সালে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার একটি ধর্ষণ মামলার মূল আসামির পরিবর্তে ৯ দিন কারাভোগ করেন ভুল আসামি রিকশাচালক মোজাফফর রহমান।

অন্যদিকে টাকার বিনিময়েও চুক্তিবদ্ধ হয়ে একজনের সাজা খাটছেন অন্যজন। এমন ঘটনাও জানাজানি হচ্ছে। এসব ঘটনাও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে। ফেনীতে ২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানের এক মামলায় মনসুর আলম নামে সাজাপ্রাপ্ত এক আসামির হয়ে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে সাজা খাটছিলেন সাইফুল ইসলাম সোহেল নামে এক যুবক। সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় আদালতের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে দুজনের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করার নির্দেশ দেন আদালত। গত ১৭ জানুয়ারি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে একজনের অপরাধে অন্যজন জেল খাটার আরেকটি ঘটনায় গঠিত বিচারিক কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জেলা ও দায়রা জজের কাছে জমা দেওয়া হয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads