• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
রাজধানীতে সক্রিয় অপরাধীচক্র

ছবি : সংগৃহীত

অপরাধ

রাজধানীতে সক্রিয় অপরাধীচক্র

জননিরাপত্তায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ১৯ মে ২০১৯

রমজান মাসকে ঘিরে রাজধানীতে সক্রিয় হচ্ছে ছিনতাইকারী, টানাপার্টি, মলমপার্টি, অজ্ঞানপার্টিসহ বিভিন্ন অপরাধীচক্র। লাগামহীনভাবে বাড়ছে এসব অপরাধীর দৌরাত্ম্য। তবে নগর পুলিশও ইতোমধ্যে এসব অপরাধীচক্রের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রতিবারের মতো এবারো রোজায় কোথাও কোথাও সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র, আবার কোথাও ছিঁচকে অপরাধীচক্র সক্রিয় রয়েছে। মলমপার্টি ট্রেনে, বাসে এবং স্টিমারে গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল যাত্রীদের টার্গেট করে চোখে মলম লাগিয়ে দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। একইভাবে খাবারের সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে অজ্ঞান করে যাত্রীর কাছে থাকা সব হাতিয়ে নিচ্ছে। ছিনতাইকারীরা অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে অবস্থান নিয়ে রিকশারোহী ও পথচারীদের আগ্নেয়াস্ত্র বা ছোরার ভয় দেখিয়ে ছিনিয়ে নিচ্ছে সব কিছু। এদের একটি অংশ প্রকাশ্যে জনাকীর্ণ রাস্তা থেকে পথচারী, রিকশারোহী ও বাসযাত্রীদের হাতে থাকা মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধীচক্রের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশের পাশপাশি সাদা পোশাকেও গোয়েন্দা পুলিশকে মাঠে নামানো হয়েছে।

সোর্সের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞানপার্টির ২৩ সদস্যকে আটক করেছে। গতকাল শনিবার সকালে নগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। অন্যদিকে গত ১২ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও শেরেবাংলানগর এলাকায় পৃথক দুই অভিযানে মলম পার্টির নয় সদস্যকে আটক করেছে র‍্যাব-২। র‍্যাব-২ সূত্রে জানা যায়, আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে মলম পার্টির এই চক্রটি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ওই রাতে মোহাম্মদপুর ও শ্যামলীর শিশুমেলার বিপরীত পাশে থেকে তাদের কার্যক্রম চালানোর প্রস্তুতির সময় হাতেনাতে তাদের আটক করে র‍্যাব সদস্যরা। র‍্যাব জানায়, সক্রিয় এই মলম পার্টির পাঁচ সদস্য হলেন— পারভেজ, লিটন, সুজন, রনি, শ্রাবণ। বাকি চারজন হলেন ছিনতাইকারী।

র‍্যাব-২-এর এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় আটক পাঁচ যুবক দীর্ঘদিন ধরে মলম পার্টির চক্রের সঙ্গে জড়িত। উৎসবকে সামনে রেখে তারা সক্রিয় হয়।

গত সপ্তাহে রাজধানীর জিগাতলা এলাকা থেকে ফরিদ নামে এক ফটো সাংবাদিককে মারধর করে তার ক্যামেরা-মোবাইলসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইচক্রের সদস্যরা। এ ব্যাপারে ওই সাংবাদিক বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু পুলিশ এ পর্যন্ত ছিনকতাইচক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করতে পারেনি।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রমজান ও ঈদে বাজারে অর্থপ্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বাড়ে। তাতে লুটের কালো থাবা বসাতে রাজধানীতে সংঘবদ্ধ হয় মৌসুমি অজ্ঞানপার্টি চক্র। পাঁচ থেকে ছয় জনের দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় তৎপরতা শুরু করে। এ ছাড়া বছরজুড়ে তাদের ‘বিচ্ছিন্ন অপারেশন’ থাকেই। রাজধানীর রেল‌স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও ব্যস্ততম এলাকায় বিভিন্ন ছদ্মবেশে ওত পেতে থাকে ওরা। ছদ্মবেশের আড়ালে বিস্তার করে থাকে ভয়ঙ্কর কালো থাবা। অভিনব কায়দায় শিকার ধরে তারা। রাস্তার ধারে ডাব, কোমল পানীয়, ইফতারি, শরব‌তে হুম্মা বিক্রির আড়ালে চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন ভূমিকায় শিকার ধরার চেষ্টা চালায়। কোমল পানীয় বা বোতলের পানির সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে তা তুলে দেওয়া হয় রোজাদার বা তৃষ্ণার্তের মুখে। তা খেয়ে অজ্ঞান হলেই চক্রের অন্য সদস্যরা তাকে বাঁচানোর নাম করে নিরাপদে নিয়ে সব কিছু হাতিয়ে নিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। গণপরিবহনের আসনে ক্লোরোফোম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করা হচ্ছে। ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, চটপটি, ক্রিমজাতীয় বিস্কুট, চকলেট, রঙিন পানীয় ইত্যাদি খাবারের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে চেতনানাশক। সিএনজি অটোরিকশা চালক সেজেও ধোঁকা দেওয়া হয়। বাসের যাত্রী সেজে পাশে বসে খোশগল্পে ঘনিষ্ঠ হয়ে গন্ধ শুঁকিয়ে বা নাকে-মুখে মলম লাগিয়ে অজ্ঞান করা হয়। অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস ব্যবহার করে যাত্রী হিসেবে গাড়িতে তুলে উদ্দেশ্য হাসিল করে অপরাধীচক্র। সব হাতিয়ে নেওয়ার পর অজ্ঞান অবস্থায় যাত্রীকে গাড়ি থেকে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে সটকে পড়ে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা যেসব মলম বা ওষুধ ব্যবহার করে তা মারাত্মক বিপজ্জনক। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুও ঘটে।

রমজানকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে প্রবেশের মুখে বাসস্ট্যান্ডগুলোসহ নগরীর ব্যস্ততম সড়ক, মার্কেট, পার্কে এদের উৎপাত বাড়তে শুরু করেছে। হাতেগোনো কয়েকটি ঘটনা সামনে এলেও বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই ঝামেলা এড়াতে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকছেন। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, সায়েদাবাদ, আরামবাগ, গাবতলী, মিরপুর, গুলিস্থান, ফার্মগেট, চিড়িয়াখানা, পল্টন, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, চানখাঁরপুল, কমলাপুর ও ঢাকা বিমানবন্দরসহ এরকম কমপক্ষে ২০টি স্পটে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে তাদের ব্যাপক তৎপরতা রয়েছে। সাভার, টঙ্গী, গাজীপুরে সক্রিয় একাধিক দল। এসব চক্রের অন্তত দেড় থেকে দুই শতাধিক সদস্য রাজধানীতে সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা গোয়েন্দা পুলিশের। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ভুক্তভোগীরা। শুধু বাসস্ট্যান্ড নয়, রাজধানীর রেল ও লঞ্চ স্টেশনগুলোতে তৎপর এই চক্র। কিন্তু এই মৌসুমি চক্রগুলো অনেক ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ হওয়ায় তাদের গ্রেফতারে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, সম্প্রতি গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানীতে সংঘবদ্ধ হয়ে তৎপরতা শুরুর কথা স্বীকার করেছে।

ঢাকা মহানগর পুলি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বাংলাদেশের খবরকে বলেন, মানুষের যাওয়া-আসার ভিড়ে অজ্ঞান ও মলমপার্টির তৎপরতা বাড়ে। প্রতিবারের মতো এবারো তারা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তবে পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা‌হিনীর পাশাপাশি‌ পথচারী ও যাত্রী‌দের চলার প‌থে সতর্ক ও স‌চেতন থাকা অ‌তি জরু‌রি বলে ম‌নে করেন তিনি। নগর পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা আরো বলেন, এবারের রাজধানীতে ঈদের কেনাকাটা নির্বিঘ্ন করতে শপিংমল ও বিপণিবিতান কেন্দ্রগুলোতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। মার্কেটের আশপাশে এবং গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে, সড়কে, গলির মাথায় পুলিশের টহলে পাশপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশও দায়িত্ব পালন করবে।

আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, কয়েক বছর ধরে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। নগরবাসী নিরাপদে আছে। ঈদে তারা গভীর রাত পর্যন্ত কেনাকাটা শেষে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরেছে। এতে পুলিশের প্রতি নগরবাসীর আস্থা বেড়েছে। এবারো নগরবাসী কেনাকাটা করে নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads