• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মিজানের খুঁটির জোর কোথায়

ছবি : সংগৃহীত

অপরাধ

মিজানের খুঁটির জোর কোথায়

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ১৩ জুন ২০১৯

একাধিক নারী কেলেঙ্কারি, সাংবাদিক ও সংবাদপাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি এবং দুদক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে তা প্রকাশ্যে জাহির করেও কীভাবে বহালতবিয়তে আছেন ডিআইজি মিজান— সর্বত্র এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। জনমনে প্রশ্ন, ডিআইজি মিজানের খুঁটির জোর কোথায়? একের পর এক অপরাধ ও বিতর্ক সৃষ্টি করার পরও তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না কেন? তার বিষয়ে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করায় দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছেন পুলিশ বাহিনীর এই বিতর্কিত কর্মকর্তা। এতে জনমনে পুলিশ সম্পর্কেও বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তর দাবি করেছে, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছেন, দোষী প্রমাণিত হলে সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, তদন্তের দরকার কী? পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে প্রকাশ্যে ঘুষ দেওয়ার কথা নিজেই বলে বেড়াচ্ছেন, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে।

সূত্র জানায়, ডিআইজি মিজানের ‘অবৈধ সম্পদ’র অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন দুদকের পরিচালক এনামুল বাছির। এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তুলে তার সপক্ষে কয়েকটি অডিও ক্লিপ সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন ডিআইজি মিজান। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এনামুল বাছিরকে; যদিও তিনি ঘুষ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

 

নারী কেলেঙ্কারি

ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ করেন মরিয়ম আক্তার ইকো নামে এক নারী। অভিযোগে প্রকাশ, ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই ইকোকে তাদের পান্থপথের বাসা থেকে একরকম কৌশলে তার গাড়িতে তুলে জোর করে ৩০০ ফুট এলাকায় নিয়ে যান ডিআইজি মিজান। সেখানে নিয়ে তাকে মারধর করেন বলে অভিযোগ করেন ইকো। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিআইজির বেইলি রোডের বাসায়। সেখানে তাকে সুস্থ করার কথা বলে ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে ফেলা হয় বলে অভিযোগ। পরদিন দুপুর ১২টার দিকে তিনি ঘুম থেকে জেগে দেখতে পান তার পরনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানের স্লিপিং ড্রেস এবং তিনি তার বেডরুমে। বুঝতে পারেন, তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এরপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে ডিএমপি কার্যালয় থেকে ছুটে আসেন মিজানুর রহমান। ইকোকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। ১৪  থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ৩ দিন ওই বাড়িতেই ছিলেন ইকো। পরে খবর দেওয়া হয় ইকোর মা কুইন তালুকদারকে। বগুড়া থেকে তার মা কুইন তালুকদার ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় ডিআইজির বেইলি রোডের বাসায় এসে পৌঁছান। এরপর অস্ত্রের মুখে জোর করে তার সঙ্গে ইকোর বিয়ে দিতে মা-মেয়েকে রাজি করান। ৫০ লাখ টাকা দেনমোহরে মরিয়ম ও মিজানুর রহমানের বিয়ে পড়ানোর জন্য মগবাজার কাজী অফিসের কাজীকে ডেকে আনা হয়। বিয়ের পর ওই রাতেই মা-মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে লালমাটিয়ায় ৫০ হাজার টাকার ভাড়া ফ্ল্যাটে নিয়ে গোপনে সংসার শুরু করেন ডিআইজি মিজান। ওই ফ্ল্যাটের নিচে সাদা পোশাকে সার্বক্ষণিক পুলিশের দুজন সদস্যকে পাহারায় রাখা হয়। এর ফলে ইকো এক রকম গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে তাকে নির্যাতন করা হতো বলেও অভিযোগ করেন ইকো। চার মাস এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর ডিআইজি মিজানকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিয়ে একটি ছবি ফেসবুকে আপলোড করেন। এতেই চরমভাবে ক্ষিপ্ত হন মিজানুর রহমান। এ ছবির বিষয়টি পুলিশের ওপর মহলে জানাজানি হয়ে যায়। ফেসবুক থেকে দ্রুত ছবিটি সরিয়ে ফেলতে তিনি লালমাটিয়ার বাসায় ছুটে আসেন। সেখানে বিষয়টি নিয়ে স্ত্রী ইকো, শাশুড়ি কুইন তালুকদারের সঙ্গে তার চরম মাত্রায় বািবতণ্ডা হয়। একই পর্যায়ে ডিআইজি মিজান ইকোর বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দেন। পরে মামলাও হয়। সেই মামলায় ৫৪ ধারায় সেগুনবাগিচার একটি  রেস্তোরাঁ থেকে পুলিশ ইকোকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তিন সপ্তাহ কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান মরিয়ম। এই ঘটনা ফাঁস করার দায়ে একটি জাতীয় দৈনিকের একজন সাংবাদিককেও হুমকি দেন মিজান। এরপর দ্বিতীয় দফায় এক সংবাদপাঠিকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় হুমকি দিয়ে বিতর্কে জড়ান ডিআইজি মিজান। ওই সংবাদপাঠিকা একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস করেন। যাতে শোনা যায়, ডিআইজি মিজান ওই সংবাদপাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। এরপর নিজের  লোকজন দিয়ে পরিবারটিকে একরকম গৃহবন্দি করে রাখেন এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠিয়ে  নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে।

 

মিজানের লঘুদণ্ড ও টিআইবির গুরুদণ্ড দাবি

ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি গত ২৮  ফেব্রুয়ারি ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে তাদের রিপোর্ট আইজিপির কাছে জমা  দেয়। পরে সেই রিপোর্ট পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তার আগেই তাকে গত ৯ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পদ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এ সময় তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাকে এপিবিএন’র ডিআইজি পদে বদলি করা হয়। এখনো তিনি স্বপদে বহাল আছেন। কিন্তু তার শাস্তি দাবি করে গত মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত বোধ করছি।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুদকের পক্ষে এর দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একই সঙ্গে ঘুষ লেনদেনে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার সকল অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দায়ও পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি দুদকের। দুদক ও পুলিশ কর্তৃৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিআইজি মিজানকে নিয়ে রীতিমতো বিব্রত পুলিশ প্রশাসন। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা এখন সময়ের ব্যাপার। একজন অতিরিক্ত আইজিপির নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলেই তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads