• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

খিলগাঁওয়ে শিশু নিনাদ হত্যার এক বছর

উদ্ঘাটন হয়নি মূল রহস্য, নতুন করে তদন্ত নেমেছে পিবিআই

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ জুন ২০১৯

এক বছরেও মূল রহস্য উদ্ঘাটিত হলো না খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া ভূঁইয়াপাড়ার ৮ বছরের শিশু সাফওয়ান আল নিনাদ হত্যার। যদিও জহিরুল ইসলাম ওরফে লুড্ডুকে একক আসামি করে তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ-ডিবি মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট)মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে দাখিল করে। তবে তার বিরুদ্ধে নারাজি দেয় বাদী স্বপন বেপারী। এখন এই মামলার তদন্ত করছে পিবিআই।

যথাযথ তদন্ত ছাড়াই মনগড়া চার্জশিট দাখিলের অভিযোগ এনে বাদী নিহতের বাবা স্বপন বেপারী গত ১৮ মার্চ মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে নারাজির পিটিশন দায়ের করলে বিজ্ঞ আদালত তা গ্রহণ করে গত ৩১ মার্চ শুনানি শেষে বাদীর নারাজি মঞ্জুর করেন এবং একই সঙ্গে পুনঃতদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়ার আদেশ দেয়া হয়।সংস্থাটি এখন তদন্ত করছে।

জহিরুল ইসলাম ওরফে লুড্ডু একক আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে ডিবি পুলিশ। গত ১৮ মার্চ জামিন বাতিল করে আদালত জহিরুল ইসলাম লুড্ডুকে জেল হাজতে প্রেরণ করে।

বাদী পক্ষের আইনজীবী নীলঞ্জনা রিফাত সুরভী জানান, বাদী তদন্ত কর্মকর্তাকে যে সব তথ্য দিয়েছেন তা যথাযথ তদন্ত না করে মনগড়া অভিযোগপত্র দেয়ায় নারাজি পিটিশন দায়ের করা হয়। বিজ্ঞ আদালত বাদীর কথা শুনে পুনরায় যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

বাদী স্বপন বেপারী বলেন, এক বছর হয়ে গেলো আমার সন্তানের হত্যার বিচার পেলাম না। হত্যাকাণ্ডটি এককভাবে হওয়ার কোনও আলামত নেই। কমপক্ষে দুই-তিন জড়িত। অথচ মাত্র একজনকে আসামি করা হয় ডিবির চার্জশিটে। আমার সন্তানকে হত্যা করে গুম করার জন্য যেভাবে ভ্যানগাড়িতে রাখা হয়েছে তাতেই প্রমাণ হয় এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আরও কেউ জড়িত আছেন। অথচ চার্জশিটে জহিরুল ইসলাম লু্ড্ডুকে একক আসামি দেখে আমি হতাশ। কারণ হত্যা ঘটনার আগে ও পরে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে নানা রকম জোরালে তথ্য ও উপাত্ত দেয়া হয়েছিল ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে। সেগুলো তদন্তের সময় তারা আমলে নেননি ডিবি। তথ্য ও ঘটনার পরম্পরায় আমার সন্তান নিনাদকে লু্ড্ডুর পরিবার এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। আমার ধারণা অন্য আসামিদের বাঁচানো চেষ্টা করা হয়েছে। তাই ডিবির চার্জশিটে তাদের নাম আসেনি। আমি চাই তাদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। তবে মূল রহস্য উদ্ঘাটন হবে।

চাঞ্চল্যকর শিশু নিনাদ হত্যা মামলায় জহির ইসলাম লুড্ডুকে একক অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা শেখ মাহবুবুর রহমান। পিবিআই নতুন করে তদন্তে নেমেছে। এখন তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক হামিদ উদ্দিন আহমেদ।

বাদী স্বপন বেপারী আর বলেন, পিবিআই এর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এবারও জোরালে তথ্য দেয়া হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জহিরুল ইসলাম ওরফে লুড্ডুর স্ত্রী খাদিজা আক্তার রানী ও তার বড় মেয়ে রুমানা ইসলাম যুক্ত। এখন পর‌্যন্ত তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি।

তাদের কেনো সন্দেহ করা হচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে স্বপন বেপারী বলেন, ওইদিন রাতে লুড্ডুর বাসায় রানীর সাথে নিনাদকে দেখা গিয়েছিল। এ রকম তথ্য দিয়েছে বিথী নামে একটি মেয়ে। সে লু্ড্ডুর ভাড়াটিয়া।ওই মেয়েটির সঙ্গে নিনাদের কথাও হয়েছে। ওই মেয়েটি অন্য আরেকজন মহিলার কাছে এ তথ্য দিয়েছে। বিথীর দেয়া তথ্য ও পারিপার্শ্বিক ঘটনার সঙ্গে অনেক কিছু মিলে যায়। এ থেকে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস লু্ড্ডুর স্ত্রী ও তার বড় মেয়ে রুমানা ইসলাম আমার সন্তানকে মেরেছে। জহিরুল ইসলাম ওরফে লুড্ডু তাদের সহায়তা করেছে মরদেহ গুম করার কাজে। তা ছাড়া নিনাদের মরদেহ যেখানে পাওয়া গেছে, সেখানে সারা রাত ঘোরাফেরা করে মামুন নামে একটি ওয়েল্ডিং ব্যবসায়ী। ওইদিন রাতে গতি-বিধি সন্দেহজনক ছিল। পরে আমরা বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরায় বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। তাকেও আইনে আওতায় আনা উচিত।

সম্পত্তি নিয়ে বিরোধে প্রাণ দিতে হয়েছে ৮ বছরের শিশু সাফওয়ান আল নিনাদকে। গত বছর ২০১৮ সালে ১৫ জুন ঈদের আগের রাতে গলায় পলিথিন পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নিনাদের মায়ের মামা জহিরুল ইসলামের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় রাজধানীর ২১৫/৫ মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ার বাসিন্দা স্বপন বেপারীর সন্তান।

পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও শ্বাসরোধ করে হত্যা করার প্রমাণ মিলেছে।

গলায় মোড়ানো পলিথিনের সূত্র ধরে হত্যার রহস্য উদঘাটন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। বনশ্রী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের তিন নম্বর ক্যাম্পাসের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছিল সাফওয়ান আল নিনাদ।

১৫ জুন ঈদুল ফিতরের আগের রাতে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় শিশুটি। ঈদের দিন দুপুরে বাড়ির পাশে বেকারি পণ্যবাহী ভ্যানের ভিতরে নিনাদের মৃতদেহ দেখতে পায় পাড়ার শিশুরা। ওই দিনই অজ্ঞাতদের আসামি করে খিলগাঁও থানায় মামলা করে নিনাদের বাবা স্বপন বেপারী।

স্বপন বেপারী বলেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ছোট ছোট বাচ্চারা বন্দুক নিয়ে খেলা করছিল। বন্দুকের নাল যাইয়া ভ্যানের ভিতর পড়ছে। বাচ্চারা দেখে ভ্যানের ভিতর লাশের মত কি জানি দেহা যায়। তখন এলাকার কিছু লোক যাইল। যাইয়া দেখল ভিতরে আছে লাশ। তখন ভ্যানডার তালাটা ভাঙল। পরে দেহে কি তার লাশটা ঐখানে আছে।

মা সোনিয়া বেগম বলেন, আমার ছেলেটা অকালে জীবন দিল। আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’

নিনাদের নানী ছালেহা বেগম বলেন, ‘অভিযুক্ত যেই হোক এমনকি আমার মায়ের পেটে ভাই হলেও নাতীর হত্যার বিচার চাই।

প্রথমে পুলিশ তদন্ত নিলেও তারা হত্যা ক্লু বের করতে পারেনি।পরে মামলার তদন্তভার নেয় গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। গলায় পেচানো পলিথিনের সূত্র ধরে শুরু হয় রহস্য উদঘাটন। ঘটনার রাতে পাশের দোকান থেকে একই রকম পলিথিন নেন নিনাদের মায়ের মামা লুড্ডু। তার বড় বোন ছালেহা বেগমের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বাবার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ চলছিল। এ ঘটনার জের ধরে শিশু নিনাদকে লুড্ডু হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে সত্যতা মিলায় তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।

গলায় প্যাচানো যে পলিথিনটি যে দোকানির কাছ থেকে লুড্ডু নিয়েছিল সেই দোকানদার সাদেক আর ঘটনাস্থলে থাকা আশরাফুল আলমের বর্ণনাতেও বের হয়ে আসে হত্যার রহস্য। এরই মধ্যে তাদের সাক্ষ্য ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

দোকানদার সাদেক বলেন, ‘লু্ড্ডু দোকানে এসে বলে আমাকে একটা চিপসের পলিথিন দাও। আমি মনে করছি ময়লা ফালানের জন্য চাইছে, আমি দিছি।’

আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমাদের পিছন দিয়া আইসা লুড্ডু কাকা একটা পলিথিন চায়। পলিথিন নিয়া সে চইল্যা যায়।’

ডিবির দেয়া চার্জশিটে বলা হয়, জমি-জমা নিয়ে বিরোধ ছিল। পরবর্তীতে বিরোধ যখন খুব তিক্ততার দিকে চলে যায় পরে এর রেশ ধরে ঘটনা ঘটে। প্রতক্ষ্যদর্শীর জবানবন্দি সঠিক ছিল। লু্ড্ডুর মোবাইল অ্যানালাইসিস করা হয়েছে। অবস্থান এনালাইসিস করা হয়েছে। সবগুলোই একই অবস্থান এবং নিনাদের লাশ যেখানে পাওয়া গেছে ওগুলোর সাথে মিলে গেছে। তাই তাকে আসামি করা হয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads