• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ধর্ষণ মামলার স্বাক্ষীর মেয়েকে গণধর্ষণের পর হত্যা

নিহত সীমা আক্তার

ছবি : বাংলাদেশের খবর

অপরাধ

ধর্ষণ মামলার স্বাক্ষীর মেয়েকে গণধর্ষণের পর হত্যা

আসামীদের দাপটে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বাদী

  • রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৯ আগস্ট ২০১৯

ধর্ষণ মামলার স্বাক্ষী ছিল সীমার মা তাসলিমা বেগম। স্বাক্ষী না দেয়ার জন্য আসামীরা তাকে বহুবার চাপ প্রয়োগ করেছেন। এমনকি রাতের আধারে বাড়িতে গিয়েও বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখায় তাসলিমাকে। কোন কিছুতেই পিছু হটেনি সে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে ধর্ষণের ঘটনার স্বাক্ষী দেওয়ায় তার  ৮ম শ্রেণীতে পড়ূয়া মেয়ৈকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।

কিন্তু কে জানতো যে অন্যের ধর্ষণের স্বাক্ষী হতে গিয়ে নিজের বুকেরধণ আদরের মেয়েকে নরপশুদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হতে হবে, এমনকি ধর্ষকদের হাতে মরতে হবে? এমন ঘটনাটি ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সামুদাফাৎ গ্রামে ঘটেছিল। গভীর রাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে তাসলিমা বেগমের মেয়ে সীমাকে একই এলাকার সুমন চৌকিদার ও দানেশ চৌকিদার পালাক্রমে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে শ্বাসরোধকরে নৃসংশভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় তাৎক্ষনিক রাঙ্গাবালী থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বেড় হলে পাল্টেযায় ঘটনার রহস্য। পটুয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারী রাঙ্গাবালী থানায় গণধর্ষণ মামলা রেকর্ড হয়। এই মামলায় বাদী হয় নিহত সীমার মা তাসলিমা বেগম।

বর্তমানে মামলার এই বাদী নিরাপত্তা হীনতায় আছেন। আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মামলা উঠিয়ে নিতে বাদীকে হুমকী দিয়ে আসছে। যার কারণে জীবন শঙ্কায় মামলার বাদী পরিবারকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে এমন অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন মামলার বাদী। গত ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার পটুয়াখালী প্রেসক্লাবে মামলার বাদী ও নিহতর মা তাছলিমা বেগম সংবাদ সম্মেলন করে আইনী সহায়তার দাবী জানান।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ঘটনার সূত্রপাত ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে একই এলাকার ১৪ বছরের অষ্টম শ্রেণীতে পড়ূয়া এক ছাত্রীকে ধর্ষণ শেষে উলঙ্গ অবস্থায় পার্শ্ববর্তী পুকুরে ফেলে দেয় সুমন চৌকিদার ও দানেশ চৌকিদার। এ ঘটনায় পরের দিন রাঙ্গাবালী থানায় মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় ২নং সাক্ষী ছিলেন তাছলিমা বেগম। তিনি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে সাক্ষী দেয়। যার কারণে আসামীরা ক্ষিপ্ত হয়ে তার মেয়ে সীমা আক্তার (১৪)কে প্রতিনিয়ত মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে অশ্লীল ভাষায় বিরক্ত করতো। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর রাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে তার মেয়ে সীমাকে আসামী সুমন চৌকিদার ও দানেশ চৌকিদার পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে তার মেয়েকে শ্বাসরোধ করে নৃসংশভাবে হত্যা করে।

নিহত সীমা আক্তার রাঙ্গাবালী হামিদিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। সীমা হত্যার ঘটনায় রাঙ্গাবালী থানা পুলিশ প্রথমে মামলা নেয়নি। পরে পটুয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারী রাঙ্গাবালী থানায় মামলা রেকর্ড হয়। এতে আসামী ছিল- সুমন চৌকিদার (২২), দানেশ চৌকিদার (২৭), সেরাজুল চৌকিদার (৫০), মো.নবীনুর (৪৫), ছাদের চৌকিদার (৬০), ইমরান চৌকিদার (২১), রাকিব চৌকিদার (২০), মোফাজ্জেল হোসেন(৪০) সহ ৮ জন।

এ মামলার পর আসামীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বাদীকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিতে থাকে। এমনকি বাদীর স্বামী ও সন্তানদের খুন-জখমের হুমকী ও ভয়ভীতি দেখায় আসামীরা। উল্লেখিত আসামীরা চলতি বছরের পহেলা জুলাই তাছলিমা বেগমের ঘরে ঢুকে তাঁর স্বামী ও সন্তানকে হত্যার চেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ তাসলিমা বেগমের। এ ঘটনায় ৩ জুলাই গলাচিপা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে নালিশি আবেদন করলে আদালত অভিযোগটি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাঙ্গাবালী থানাকে আদেশ দেন। কিন্তু তাছলিমার অভিযোগ পুলিশ এখনও মামলাটি রেকর্ড করেনি। আসামীরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে এবং মামলা তুলে নিতে বাদী ও তার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। তার মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তাছলিমা বেগম।

অপরদিকে পুলিশ জানায়, ৩ জুলাই তাসলিমা বেগম গলাচিপা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে যে নালিশি আবেদন করেন তা তদন্ত করার জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে। এই অভিযোগের তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এর আগে সীমা হত্যার ঘটানায় যে মামলা হয়েছিল সেই মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। সীমা হত্যার ঘটনার সত্যতা থাকলেও বর্তমানে মামলার বাদী তার স্বামী ও সন্তানদের হত্যার হুমকির যে অভিযোগ করছেন তা সঠিক নয়। কারণ মামলার বাদী ও তার পরিবারের লোকজন কয়েক মাস যাবৎ এলাকাতেই নেই, তারা ঢাকাতে রয়েছেন।

প্রতিবেদকের সাথে মুঠোফোনে কথা হয় মামলার ১ম আসামী সুমন চৌকিদারের পিতা ও মামলার ৩নং আসামী সিরাজুল চৌকিদারের সাথে। তিনি বলেন, ডাক্তারি মেডিকেল রিপোর্ট আমাদের পক্ষে কিন্তু থানার রিপোর্ট আমাদের বিপক্ষে। পুলিশ চার্জশিট লিখেছে বাদীর পক্ষে অর্থাৎ গণধর্ষণ বলা হয়েছে। অথচ এই ঘটনায় মেডিকেল রিপোর্ট ছিল অপমৃত্যু। মেডিকেল রিপোর্টে উল্লেখ ছিল গণধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি। তবে শরীরে আঘাত আছে বলা হয়েছে। কিন্তু কিসের আঘাত সেটা উল্লেখ করা নেই। মেডিকেল রিপোর্টের দ্বারাও প্রমানিত হয় এটি কোন গণধর্ষণের পর হত্যা নয়। নতুন করে এখন আবার হাইকোর্ট থেকে সিভিল সার্জন ও ডাক্তারকে তলব করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যার পরবর্তি রেজাল্ট এখনো পর্যন্ত আসেনি। আমাদেরকে ফাঁসানোর জন্যই মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে এসব টালবাহানা করা হচ্ছে।

রাঙ্গাবালী থানা অফিসার ইনচার্জ আলী আহম্মেদ জানান, সীমা হত্যার ঘটনায় আসামীদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৮ জুলাই অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। মামলা এখন বিচারাধীন রয়েছেন।

আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, ওই মামলায় মোট ৮জন আসামী। এরমধ্যে ৩ জন জামিনে রয়েছেন, ৩ জন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল এবং বাকি দুই জন পালাতক রয়েছে। পালাতকদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, আসামী পক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বিপরীত ধর্মী তথ্য দেওয়ায় পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. শাহ মো.মোজাহিদুল ইসলাম ও মেডিকেল অফিসার রেজাউর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আদেশ দেয় হাইকোর্ট।

চলতি বছরের ২২ মে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো.মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছিলেন। তলব আদেশে আদলতে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান সিভিল সার্জন।

আদালত ক্ষমা না করে চিকিৎসককে বলেন, এভাবে যদি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেন তাহলে জাতির কাছে কী বার্তা যায়? এভাবে রিপোর্ট প্রদানের কারণে একটা মামলার বিচার প্রভাবিত হয়। পরে আদালত ক্ষমার আবেদন নাকচ করে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads