• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

যুবলীগ নেতা রাশেদ হত্যাকাণ্ড

এক বছরেও গ্রেপ্তার হয়নি সুন্দরী সোহেল

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রাজধানীর মহাখালীতে যুবলীগ নেতা কাজী রাশেদ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি ইউসুফ সরদার সোহেলকে (ওরফে সুন্দরী সোহেল) এক বছরের বেশি সময় ধরেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে চাঞ্চল্যকর এই খুনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত চার খুনিরও হদিস মিলছে না। বাদী ও চিহ্নিত ওই চার খুনির পরিবারের সদস্যদের আশঙ্কা, হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী-প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতে তাদেরও হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছে সুন্দরী সোহেল।

জানা গেছে, ঘটনার পর থেকে আত্মগোপনে থাকা মামলার প্রধান আসামি সোহেল বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়ায় অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই নিজ ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন বনানী-মহাখালী এলাকা। এমনকি মামলা তুলে নিতে বাদী নিহত রাশেদের স্ত্রী মৌসুমী আক্তারকে দেখিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকার প্রলোভন। তাতে রাজি না হওয়ায় কখনো দিচ্ছেন প্রাণনাশের হুমকি। আবার কখনো মৌসুমীর অশ্লীল ছবি তৈরি করে ভাইরাল করারও হুমকি দিচ্ছেন। এ বিষয়ে গত ২৪ জুলাই বনানী থানায় জিডি করেছেন মৌসুমী।

সম্প্রতি একটি ফোন নম্বর থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের এক কর্মকর্তার কাছে ফোন দেন সুন্দরী সোহেল। নম্বরটির অবস্থান এস্তোনিয়ায় বলে এরই মধ্যে শনাক্ত করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

গত ৩১ জুলাই দুপুর ১২টায় অপরিচিত সেই একই নম্বর (প্রাইভেট) থেকে মামলার বাদী মৌসুমীকেও ফোন দিয়েছিলেন সোহেল। তবে অব্যাহত হুমকির কারণে ভয়ে সেই ফোন রিসিভ করেননি বলে জানিয়েছেন মৌসুমী।

ঘটনার পর থেকে হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ্যভাবে জড়িত দীপু, হাসু, ফিরোজ ও জহির একবারের জন্যও বাদীর সঙ্গে কথা দূরে থাক, নিজ পরিবারের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করেননি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে-খুনে অভিযুক্ত এই চারজন এখন কোথায়? মামলার বাদী মৌসুমী আক্তারের সন্দেহ, সাক্ষী না রাখতে ওই চারজনকেও হত্যার পর লাশ গুম করেছেন সোহেল। তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও মৌসুমীর এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। একই আশঙ্কা করছে দীপু, হাসু, ফিরোজ ও জহিরের পরিবারও।

রাশেদ হত্যা মামলার বাদী মৌসুমী বলেন, মামলা তুলে নিতে সুন্দরী সোহেল ও তার ক্যাডারদের হুমকি-ধমকিতে এ পর্যন্ত ৫টির মতো জিডি করেছি আমরা। কিন্তু এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। মামলার প্রধান আসামি সোহেল, জাকিরের অবস্থান জানা গেলেও অন্য চার খুনি দীপু, হাসু, ফিরোজ ও জহিরকে কেউ কোথাও দেখেনি। এমনকি এখন পর্যন্ত তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ঘটনার পর থেকে তারাও নিখোঁজ বলেই আমি ধারণা করছি। সাক্ষী শেষ করে দিতে ওই বাকি চারজনকেও হয়তো সোহেল খুন করেছেন। তবে সোহেল ধরা পড়লেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।

মহাখালীর আকিজপাড়ায় বাসা অভিযুক্ত দীপুর। ঘটনার পর থেকেই তিনি বাসা থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। জানতে চাইলে তার স্ত্রী রিয়া মাহবুব বলেন, রাশেদ হত্যাকাণ্ডের সময় তার মেয়ে দিহি ছিল নয় মাসের পেটে। কিন্তু ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও একবারের জন্য দীপু আমাদের খবর নেয়নি। এটা হতে পারে না। হয়তো রাশেদের মতো ওরও কিছু হয়েছে। আমার স্বামী অপরাধ করলে তাকে আইনের কাছে সোপর্দ করার দাবি করছি।

মহাখালীর দক্ষিণপাড়ার বাসায় কথা হয় আরেক অভিযুক্ত ফিরোজের স্ত্রী মাসুদার সঙ্গে। তিনি বলেন, তাদের দুই মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে ১২ মাস বয়সী ফাতেমাকে এখনো দেখেনি ফিরোজ। রাশেদ হত্যার পর থেকে সে নিখোঁজ। আমার কিংবা সন্তানদেরও খোঁজ নেয়নি। তারও হয়তো কোনো অঘটন ঘটেছে। জীবিত ফিরোজ না হোক, অন্তত তার লাশটুকু যেন আমরা ফেরত পাই। মাসুদার সঙ্গে এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন ফিরোজের মা ফিরোজা বেগমও।

রাশেদ হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাশেদ হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর থেকেই আমরা অভিযুক্ত সবার পরিবারের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ব্যক্তি জীবনেও নজরদারি করছি। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত দীপু, হাসু, ফিরোজ ও জহির এখন পর্যন্ত তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

তিনি বলেন, সম্প্রতি এস্তোনিয়ার একটি নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসে। ধারণা করছি, সেটি সোহেলের। কিন্তু অভিযুক্ত ওই চারজনের অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি।

সাক্ষী সরিয়ে দিতে ওই চারজনকেও হত্যা করা হয়েছে-বাদীর এমন আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছি না। বিষয়টি আমরাও খতিয়ে দেখছি। তারা থাকলে হয়তো এক জায়গায়ই আছে। না হলে হয়তো কিছু ঘটেও যেতে পারে। সেটা আসলে এখনো ঠিক করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৪ জুলাই রাতে মহাখালীর স্কুল রোডের জিপি-গ/৩৩/১ নম্বর ভবনে গুলি করে যুবলীগ নেতা কাজী রাশেদকে হত্যা করা হয়। রাশেদ একসময় ছিলেন সুন্দরী সোহেলের দীর্ঘদিনের সহযোগী। ১৫ জুলাই ভোরে সুন্দরী সোহেলের সম্পাদিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল রেইনবো নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম অফিসের পেছন থেকে রাশেদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলেও গ্রেপ্তার দেখিয়েছে বনানী থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জাকির হোসেন সরদারকে। জাকির হোসেন সম্পর্কে সোহেলের চাচা। গত বছরের ৮ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে জাকির হোসেন স্বীকার করেছেন, তার ভাতিজা সোহেলই যুবলীগ নেতা রাশেদ হত্যাকাণ্ডের হোতা। খুন এবং ওই ভবন থেকে লাশ সরানো পর্যন্ত সোহেলকে সহযোগিতা করে দীপু, হাসু, ফিরোজ, জহিরসহ অচেনা আরো দু-তিনজন।

জাকিরকে ঘটনার আগে সোহেল ও ফিরোজ ডেকে নিয়ে বলে, ‘আজ রাশেদকে ফালায়া দিমু, তুই নিচে পাহারায় থাকিস। কেউ যেন ওপরে যেতে না পারে।’ হত্যাকাণ্ডের পর খুনিরা লাশ ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়ার যে দৃশ্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়েছে সেখানেও সোহেল, ফিরোজ, হাসু, দীপু ও জহিরসহ মোট ছয়জনের উপস্থিতি দেখা গেছে।  গত বছরের ৭ আগস্ট জাকিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। অথচ জাতীয় নির্বাচনের কয়েক দিন আগেই জামিনে ছাড়া পেয়ে যান জাকির হোসেন সরদার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads