• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে ধর্ষণ

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, একশ্রেণির মানুষের বিকৃত লালসা চরিতার্থ এবং ধর্ষিতার প্রতি সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ধর্ষণকারীরা উৎসাহিত হয়ে অবলীলায় ধর্ষণকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর আক্রান্ত নারীকে থানায় মামলা করতে যেতে হয়, সেখানে প্রথম দফায় ধর্ষণের ঘটনা বর্ণনা করতে হয়, মেডিকেল টেস্ট করাতে হয়, দ্বিতীয় দফায় তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়, আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবীর জেরার নামে নানা অশ্লীল কথা শুনতে হয়। এছাড়া একজন ধর্ষিতার সঙ্গে তার পরিবার ও সমাজ এমন ব্যবহার করে যে তাতে মনে হয়, ধর্ষণকারী নয় ধর্ষিতাই অপরাধী। এসব কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষিতারা সামাজিক বিচার ও আদালতের বিচারেও উপেক্ষিত হন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতারা উপায়ান্তর না দেখে আত্মহননের পথ বেছে নেন। ধর্ষকরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, কয়েক দিন পর বেমালুম ভুলে গিয়ে আবারো ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। এ অবস্থা চারপাশের আরো অনেকে ঘৃণিত কাজে উৎসাহ জোগায়।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশে এখন নারী ও শিশু ধর্ষণের মচ্ছব চলছে। দিনরাত ধারাবাহিকভাবে একই স্টাইলে এ জাতীয় যৌন সন্ত্রাসের ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক নেমে এসেছে কর্মজীবী নারী, শিশু,  ছাত্রী, শিক্ষিকা ও গৃহবধূদের মধ্যে। শুধু  যে রাতের অন্ধকারে, নির্জন রাস্তায়ই নারীর সম্ভ্রম লুট করা হচ্ছে, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্তচিন্তার নিরাপদ পরিবেশেও উচ্চ শিক্ষার্থী নারীও নিরাপদবোধ করতে পারছেন না। এসব জায়গাও সুযোগ-সন্ধানী ধর্ষকের দল ওত পেতে আছে। আকস্মিক এ ধরনের যৌন সন্ত্রাসের  দৌরাত্ম্যে সর্বত্র উদ্বেগ নেমে এলেও পুলিশ হাঁটছে সেই পুরোনো পথেই। সেই চিরাচরিত ভাষায় পুলিশ বলছে, এসব বিছিন্ন ঘটনা। মাঝে মাঝে এ জাতীয় অপরাধ একসঙ্গে ঘটে বলে মনে হয় হঠাৎ এই অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে। অবশ্য পুলিশের এ বিশ্লেষণকে দায় এড়ানোর  কৌশল উল্লেখ করে অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ জাতীয় অপরাধ আগেও ঘটত। এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকাশও পাচ্ছে ব্যাপক হারে। এজন্য দায়ী অনেকগুলো ফ্যাক্টর। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধ না করা  গেলে সামনের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিকার ও সমাধানের উপায় প্রসঙ্গে মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী কোনো আসামির পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া না থাকলে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। ধর্ষিতারা পরতে পরতে উপেক্ষিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্ষকেরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোনো শাস্তি হয় না। এই আইনজীবী বলেন, বিচার প্রার্থীকে কোনো ধরনের আইনজীবীর সহায়তা দেওয়া ছাড়া আদালতে তোলা যায় না কোনোভাবেই। এই বিষয়টি যে রকম আমাদের সংবিধানে আছে, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের অনেক জাজমেন্টেও রয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক আইনের অনেক ধারাতেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলের আইন থেকে আমরা দেখছি যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ রকম ক্ষেত্রে অভিযুক্ত হিসেবে একজন নারীর মামলা চালানো কঠিন ব্যাপার। আমাদের সমাজে নারীদের পরতে পরতে সমস্যার মুখে পড়তে হয়। যেমন ধর্ষণের একজন ভিকটিমকেও নিজের প্রমাণ করতে হয়  যে সে ধর্ষিত হয়েছে এবং বিচার চলাকালে তাকে  দোষারোপ করার প্রবণতাও দেখা যায়। 

তিনি আরো বলেন, ছোট শহরগুলোতে অনেকেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকার কারণে অনেক সময় চাইলেও সাহস করে এগিয়ে আসেন না অনেক আইনজীবী। আমরা সবাই জানি, একটা মামলার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য শুনে, বিভিন্ন প্রমাণ পর্যালোচনা করে, দুই পক্ষের সব ধরনের বক্তব্য আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হন বিচারক।

তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ঈদ এলে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ঢুকে পড়ে তরুণ ও যুবকের দল। তারা তরুণীদের স্পর্শকাতর অংশে হাতের ছোঁয়া লাগিয়ে বিকৃত উল্লাসে মেতে ওঠে। বাঙালির প্রাণের উৎসব বর্ষবরণে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হন নারীরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় একজন করে নারী নির্যাতনের শিকার হয়। এ নিয়ে দেশে তেমন প্রতিবাদ হয় না। আওয়াজ একেবারেই হচ্ছে না তা নয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই নারীরা নিরাপত্তাহীন। নিরাপদ নয় স্বামী, শিক্ষক, বন্ধু।

বর্তমানে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এক বছর বয়সী শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা এ বর্বরতার শিকার হচ্ছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী ও শিশু লাঞ্ছনার ঘটনা  বেড়ে চলেছে। বিচারহীনতা ধর্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুললে সেখান থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের মতে, ধর্ষণ আগেও ছিল এখনো রয়েছে। তবে মিডিয়ার বিকাশের কারণে এখন তা বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। একমাত্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এ লক্ষ্যে তারা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার সুপারিশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads