রাজধানীর অনেক ক্লাবের প্রচলিত জুয়ার আসরকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণসজ্জিত করে ক্যাসিনোতে রূপান্তর করেন একদল নেপালি। জুয়া চালাতে তাদের ভাড়া করে আনেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কিছু নেতাকর্মী।
চুক্তির বিনিময়ে এসব নেপালি কাজ করলেও জুয়ার মূল টাকা যেত নেতাদের পকেটে। আর জুয়ার কারবার নির্বিঘ্ন করত পুলিশ প্রশাসন। র্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া রিমান্ডে ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
গত বুধবার রাজধানীর গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে বৃহস্পতিবার অস্ত্র ও মাদক মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে মহানগর ডিবি পুলিশ।
গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের (ডিবি) উত্তর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক মামলার তদন্তের দায়ভার পড়েছে ডিবির ওপর। তাকে সাত দিনের রিমান্ডে এনে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। মামলার নথিও আমরা হাতে পেয়েছি।
মশিউর রহমান আরো বলেন, রাতে তার রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর সরাসরি খালেদকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। তারপর থেকে রিমান্ডে রেখে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এ ঘটনায় আর কে কে জড়িত রয়েছে, তা আমরা জানার চেষ্টা করছি। রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন খালেদ মাহমুদ।
ডিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রিমান্ডে বেশ কয়েকজন সহযোগীর নাম বলেছেন খালেদ। এদের মধ্যে আছেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়ার কর্ণধার চোরা সেলিম ওরফে সেলিম চেয়ারম্যান ওরফে সেলিম খান। ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজির একটি বড় অংশ তার মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করতেন যুবলীগ নেতা সম্রাট ও খালেদ। রিকশা চোর থেকে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক সেলিম খান। ক্যাসিনো ব্যবসা, অবৈধভাবে মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন, টেন্ডারবাজিসহ নানাভাবে এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ এই সেলিম খান। শাকিব খানকে নিয়ে একসঙ্গে ৫টি ছবি প্রযোজনা করে চলচ্চিত্রপাড়ায় আলোচনায় আসেন তিনি। এ পর্যন্ত শতকোটি টাকা শুধু সিনেমায় লগ্নি বলে চলচ্চিত্রপাড়ায় আলোচনা রয়েছে সেলিম খান।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, অবৈধ ক্যাসিনো নিয়ে আরো তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিশ্চিত তথ্য-প্রমাণ নিয়ে আরো অভিযান হবে।
ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ আরো জানিয়েছেন, বিনোদনকেন্দ্রের নামে সিঙ্গাপুর এবং লাসভেগাসের আদলে রাজধানীতে গড়ে তোলা হয় এ ক্যাসিনো। আলো ঝলমলে জাঁকজমকপূর্ণ জুয়ার আসরে প্রতিদিন চলত কোটি কোটি টাকার লেনদেন। আর এসবের নেপথ্যে নেপালি জুয়াড়িচক্র। ১১ নেপালির হাত ধরেই বাংলাদেশে ক্যাসিনোর বিস্তার। এদের মধ্যে রয়েছেন দিনেশ শর্মা, রাজকুমার, বিনোদ, দিনেশ কুমার, ছোট রাজকুমার, বল্লভ, বিজয়, সুরেশ পাটেল, কৃষ্ণা, জিতেন্দ্র, নেপালি বাবা। এর মধ্যে দিনেশ শর্মা ও রাজকুমারকে বাংলাদেশের ক্যাসিনো জগতের ডন বলা হয়ে থাকে। আর নেপালি বাবা, বল্লভ ও বিজয় ক্যাসিনো ব্যবসায় প্রশিক্ষণ ও সহায়তার কাজ করত।
রাজধানীতে সক্রিয় বেশিরভাগ আধুনিক ক্যাসিনোর অপারেটিং সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করেন এরা। অনেক ক্যাসিনোর মালিকও হয়ে গেছেন এরা। মতিঝিলের দিলকুশা ও এলিফ্যান্ট রোডের অ্যাজাক্স ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করে নেপালের নাগরিক রাজকুমার।
র্যাব জানায়, বিদেশিরা বাংলাদেশে এভাবেই বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া একসময় ছিলেন ফ্রিডম পার্টির কর্মী। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলাকারী ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর হাত ধরে তার রাজনৈতিক পথচলা। তার বেড়ে ওঠা রাজধানীর শাহজাহানপুরে, সেসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবে ভোল পাল্টান দ্রুত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভিড়ে যান যুবলীগে। শুরু করেন যুবলীগের রাজনীতি। খুব দ্রুতই দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর যুবলীগে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সময় নেননি খুব বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার আশীর্বাদ পেয়ে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির মাধ্যমে যুবলীগের ক্ষমতাধর নেতা হয়ে ওঠেন খালেদ মাহমুদ। প্রকাশ্যে এমন রাজনীতি করলেও অপরাধ জগতেও ছিল তার অবাধ বিচরণ। অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়েও কাজ করতেন তিনি। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতেন সবসময়; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পরে যুবলীগের কিছু নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর চার দিনের মাথায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হতে হলো তাকে।
র্যাব, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ তার রাজনৈতিক উত্থানের বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও অবৈধভাবে ক্যাসিনো পরিচালনা করে আয় করা অর্থ কোথায় কোথায় মাসোহারা হিসেবে দিতেন জানিয়েছেন সেসব তথ্যও। অবশ্য এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি।
তবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম করে আসছিলেন খালেদ। তার সঙ্গে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ দলটির অনেক নেতা যেমন জড়িত তেমনই এই তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রীও রয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ছিল ক্ষমতাসীন দলে খালেদ মাহমুদের ‘রাজনৈতিক গুরু’। একসময় সম্রাটের অধীন হয়ে কাজ করলেও পাঁচ-সাত বছর ধরে তিনি নিজেই ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করতেন। তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছিল রাজধানীর মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মুগদা। এসব এলাকার সবকিছুরই নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। যুবলীগ নেতা পরিচয়ে এসব এলাকায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশিরভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদ মাহমুদ। ভুঁইয়া অ্যান্ড ভুঁইয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। কমলাপুর এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বড় বড় টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন খালেদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কুমিল্লার বরুড়া থানাধীন সরাফতি গ্রামে বাড়ি খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার। তার বাবার নাম আবদুল মান্নান ভুঁইয়া। অবশ্য কুমিল্লায় জন্ম হলেও তার বেড়ে ওঠা ঢাকার শাহজাহানপুরে। ১৯৮৯ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর হাত ধরে উত্থান হয় তার। সে সময় ফ্রিডম পার্টির কর্মী ছিলেন খালেদ। পরে ২০০১ সাল চারদলীয় জোট সরকারের সময় তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। খিলগাঁও-শাহজাহানপুর এলাকায় সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের হয়ে তিনি এলাকায় চাঁদাবাজি করতেন। হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে পড়াশোনা করার সময় তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে পুলিশের সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশের গুলিতে তার একটি পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই তাকে ল্যাংড়া খালেদ নামে অনেকে চেনেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১০ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ২০১৩ সালে বিশাল শোডাউন করে তিনি যুবলীগে যোগদান করেন। সাধারণ সদস্য পদ না থাকলেও অর্থের বিনিময়ে তিনি সরাসরি সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এরপর থেকেই আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন খালেদ। মতিঝিল এলাকার সব চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি একসময় নিয়ন্ত্রণ করত মিল্কী, তারেক ও চঞ্চল। ২০১৪ সালে মিল্কী খুন হওয়ার পর ক্রসফায়ারে মারা যায় তারেক। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় চঞ্চল। এরপর পুরো ফাঁকা মাঠের দখল নেন খালেদ।
সূত্র জানায়, যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের সঙ্গে লিয়াজোঁ ঠিক রেখে সবকিছু করতেন খালেদ। মতিঝিল এলাকার জুয়ার আসরগুলো নিয়ন্ত্রণে নেন নিজের হাতে। এরই মধ্যে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে তার সঙ্গে সখ্য হয় দুবাইয়ে পলাতক থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে। জিসানের সঙ্গে গত কয়েক বছর একসঙ্গে কাজ করলেও সম্প্রতি তার সঙ্গেও বিরোধ শুরু হয়। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে নিজের পূর্ণাঙ্গ বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল তার। এছাড়া তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের কাছে অবৈধ অস্ত্রও রয়েছে অনেক। চলাফেরা করার সময় বিশাল ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করার অভিযোগও রয়েছে গ্রেপ্তার হওয়া খালেদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খিলগাঁও-শাহজাহানপুর হয়ে চলাচলকারী লেগুনা ও গণপরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন খালেদ। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে প্রতি রাতে মাছের একটি হাট বসিয়ে চাঁদা নিতেন যুবলীগের এই নেতা। খিলগাঁও কাঁচাবাজারের সভাপতিও তিনি। তার বিরুদ্ধে শাহজাহানপুরে রেলওয়ের জমি দখল করে দোকান ও ক্লাব বানানোর অভিযোগও আছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গত ৩-৪ বছর ধরে খালেদের উত্থান হয়েছে বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে চলতেন তিনি। এ কারণে এর আগে কেউ ঘাঁটায়নি তাকে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণেই তার বিষয়টি সামনে এসেছে।