• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

আরেক গডফাদার নিখিল

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ০৩ অক্টোবর ২০১৯

রাজধানীতে অপরাধজগতের আরেক গডফাদার যুবলীগ নেতা মাইনুল হোসেন খান নিখিল। ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের এই সভাপতি এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে জড়িত নন। চলমান ক্যাসিনোদুর্নীতি ও চাঁদাবাজিবিরোধী অভিযানে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর সাম্রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হানা দিলেও নির্বিঘ্নে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন উত্তরের যুবরাজখ্যাত মাইনুল হোসেন খান নিখিল।

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভূমিদখল, স্পা ব্যবসা, ক্যাসিনো ব্যবসা ও সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অবৈধ ব্যবসা থেকে আয় করা টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এই যুবলীগ সভাপতি। 

বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তরের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গা-ঢাকা দেওয়ার পর রাজধানীর অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন উত্তরের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিল। তার নিজস্ব বাহিনীই মহানগরীর ফুটপাতে চাঁদাবাজি-মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। এছাড়া টাকার বিনিময়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের শেল্টার দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা কমিটির পদ পেতে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে। ফলে পদবঞ্চিত হতে হয়েছে প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের। টাকার বিনিময়ে জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মী এখন যুবলীগের বিভিন্ন পদ ভাগিয়ে নিয়েছেন।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় সরকারি জায়গা দখল করে একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন যুবলীগের এই সভাপতি। সেখানে প্রতিটি দোকান থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা ভাড়া তুলে নিজের পকেট ভারী করছেন।  এছাড়া পল্লবীর মল্লিকা হাউজিং এলাকায় জাল কাগজপত্র দিয়ে দুটি প্লট দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। মিরপুর এলাকার অধিকাংশ গার্মেন্ট থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হয় তাকে। এছাড়া ফুটপাতের চাঁদা তোলে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। চাঁদা না দিলেই সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। যুবলীগ উত্তরের সহসভাপতি জাকির হোসেন বাবুলকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি টর্চার সেল। তাদের নির্দেশমতো কাজ না হলে টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় ব্যবসায়ীদের। 

গোয়েন্দা সূত্র আরো জানায়, একদিনেই ১০ লাখ ইউরো বিদেশে পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। বেলজিয়ামে রয়েছে তার একটি অত্যাধুনিক পেট্রোল পাম্প। এছাড়া তার একাধিক বাড়িও রয়েছে বিভিন্ন দেশে।

জানা গেছে, মিরপুরের এক আতঙ্কের নাম মাইনুল হোসেন খান নিখিল। তার ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পান না। অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির এই লোক অবৈধ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ২৯৬ দক্ষিণ মনিপুর, ৫৫৩ মাইকওয়ালা মসজিদ, ৮৮৮ মধ্য মনিপুর মোল্লা রোড, ১২৬৭/৩ পূর্ব মনিপুর বালির মাঠ, ১৯৩/৩ সেনপাড়া, ১৩ বাউন্ডারি রোড, সেকশন-৬ পশ্চিম সেনপাড়ার বাসাগুলো দখলের অভিযোগ রয়েছে। বাইশবাড়ি এলাকার সমস্ত বাড়ির কাজ ও মাইকওয়ালা মসজিদ পর্যন্ত পানির লাইনের কাজ করতে হলে তাকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিয়ে কেউ কোনো কাজ করতে পারেন না। এছাড়া মোল্লা রোড এলাকায় তার পক্ষে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ নেতা আহাদ মোল্লা ও সাগর মোল্লা। খেজুরতলা থেকে বাইশবাড়ি পর্যন্ত মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন শাহজাহান, কামরুল, নূর হোসেন, সামসুল হক শাওন ও তার ভাই বাদ্দু। মোল্লাপাড়া থেকে ৬০ ফিট মাইকওয়ালা মসজিদ পর্যন্ত মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক নিখিলের ভাগিনা মাহবুব ও গফুর মোল্লা। এছাড়া পুরো দক্ষিণ মনিপুর, পূর্ব মনিপুর, পশ্চিম মনিপুর, মধ্য মনিপুরসহ পুরো মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজি ও অসামাজিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে নিখিলের ছোট ভাই ওপেল, ভাগিনা হিমেল, মাজু মোল্লা, মাহবুব, শাহজাহান, কামরুল, হানিফ, আহাদ মোল্লা, মিঠু, সবুজসহ নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। মহাখালীর কড়াইল বস্তি, মিরপুরের একাধিক বস্তিতে অবৈধ গ্যাস ও পানির লাইন সংযোগের সঙ্গে তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে মাইনুল হোসেন খান নিখিলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মিথ্যা অভিযোগে তাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের মার্কেটটি তার নয়। তিনি সেখানে কয়েকটি দোকান কিনেছেন। এছাড়া পল্লবীর মল্লিকা হাউজিংয়ে তার কোনো বাড়ি নেই, তিনি সেখানে দুটি বাড়ি ডেভেলপ করেছেন। জামায়াত-শিবিরের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার বাড়ি জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর বাড়ির পাশে। তাদের তিনি কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। বেলজিয়ামে পেট্রোল পাম্প সম্পর্কে তিনি বলেন, সেখানে আমার ভাইয়ের নামে একটি বাড়ি আছে। আমার ভাই সেখানে ব্যবসা করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান সেখানে থাকেন। পেট্রোল পাম্প থাকার তথ্যটি সঠিক নয়।  

গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই আলোচনায় আসে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নাম। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের চারদিনের মাথায় ১৮ সেপ্টেম্বর সম্রাট-খালেদ নিয়ন্ত্রিত ক্যাসিনোগুলোতে অভিযান শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ওই দিনই গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় খালেদকে। খালেদকে গ্রেপ্তারের খবর পেয়েই আতঙ্কে কয়েকশ নেতাকর্মী নিয়ে কাকরাইলের রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের বিপরীতে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান নেন সম্রাট। সেখানে কয়েক দিন থাকেন তিনি। প্রতিদিনই সেখানে শত শত নেতাকর্মী তাকে পাহারা দিয়ে রাখেন। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে তুমুল আলোচনা চলতে থাকে শেষ পর্যন্ত সম্রাটকে গ্রেপ্তার করা হবে কিনা। কয়েক দিনের মাথায় কার্যালয় থেকে সটকে পড়েন সম্রাট। অনেকটা আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads