• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

কালো টাকায় নব্য ধনী

নাইটগার্ডের ছেলে ধনকুবের নাজমুল

  • শওকত জামান, জামালপুর
  • প্রকাশিত ০৬ অক্টোবর ২০১৯

বাবা নাইটগার্ড শাহজাহানের পরিবারে দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠে সিদ্দিকী নাজমুল আলম। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় নাজমুল। বাবা জেলা খাদ্য অফিসে নাইটগার্ডের চাকরি করত। বাড়ি জামালপুর শহরের পাথালিয়ায়। অভাব-অনটনের সংসার ছিল তাদের। দুচালা একটা টিনের ঘরে কেটেছে নাজমুলের শৈশব-কৈশোর। জামালপুর জিলা স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর ছেলের লেখাপড়ার সঙ্গতি ছিল না নাজমুলের বাবার। তার চাচা মামীম শহরের পাথালিয়া গ্রামের বকুলতলা মোড়ে মনোহারি দোকান করে পড়ালেখা খরচ জোগাত। হেঁটেই স্কুলে যাতায়াত করত। নতুন কাপড় কপালে জোটাও ছিল নাজমুলের স্বপ্ন।

জামালপুর জিলা স্কুল থেকে ২০০০ সালে এসএসসি ও ২০০২ সালে সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সে। তখনো তাকে তেমন চিনত না কেউ। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্থানীয় শিবির নেতা আবদুর রহমান ও বাবুর পিছু পিছু ঘুরতে দেখা গেছে নাজমুলকে। তখন দাড়ি রেখে পাঞ্জাবি পরে চলাফেরা ছিল তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। সূর্যসেন হলে থেকে তখন সে নিয়ন্ত্রণ করত ঢাকার রমনা পার্ক ও আশেপাশের এলাকার টোকাইদের। সে সময়ে টোকাইদের বেত দিয়ে শাসনের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। ডানপিঠে স্বভাবের কারণে নজরে আসে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি লিয়াকত শিকদারের। তারপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। লিয়াকত শিকদারের হাত ধরেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন নাজমুল। তারপর তিনি জড়িয়ে পড়েন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে বর্তমানের আলোচিত ক্যাসিনোর গডফাদার যুবলীগের ইসমাইল হোসেন সম্রাটের। ছাত্রলীগের প্রভাবে ঢাকা ও তার নিজ এলাকা জামালপুরে তৈরি করেন একাধিক অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী। শুরু করেন বিভিন্ন দপ্তরে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও দখলদারি। কোকেন ও গোল্ডের ব্যবসাও করতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর পরই শেরাটন হোটেলের ডিসকোতে নিয়মিত যাতায়াত করত বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এছাড়া তার ঢাকার বিভিন্ন বার ও ক্যাসিনোতে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। গুঞ্জন রয়েছে, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ইডেন কলেজের এক নেত্রীর সঙ্গে গড়ে ওঠে তার অবৈধ সম্পর্কও। অবশেষে তার সঙ্গেও প্রতারণা করেছে নাজমুল।

সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর রাতারাতি পাল্টে যায় নাজমুলের নিজের অবস্থা ও তার পরিবারের চেহারা। বাবা শাহজাহান সিদ্দিকীকে খাদ্য অফিসের নাইটগার্ড থেকে খাদ্য পরিদর্শক পদে পদোন্নতি, ছোট ভাই আদনান সিদ্দিকীকে সিম্ফনি মোবাইল ফোন ও বিকাশের ডিলার এবং চাচা মামীম সিদ্দিকীকে বাজাজ মোটরসাইকেল কোম্পানির ডিলার বাগিয়ে দেন নাজমুল।

শাহজাহান সিদ্দিকী লেখাপড়া করেছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। চাকরি নেয় জেলা খাদ্য অফিসে নাইটগার্ডের। তার বেতনের টাকায় পরিবারের ভরণ পোষণ চালানোও ছিল কষ্টসাধ্য। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ছেলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর একাধিক পদ টপকে খাদ্য পরিদর্শক হয়ে যান শাহজাহান। আগে নুন আনতে পান্তা ফুরায় শাহজাহান এখন অফিসে যাতায়াত করেন বিলাসবহুল পাজেরো গাড়িতে।

চাচা মামীম সিদ্দিকী পাথালিয়া গ্রামের বকুলতলা মোড়ে মনোহারি দোকান করত। পরে হাসপাতালের সামনে ওষুধের ফার্মেসি দেয়। সিদ্দিকী নাজমুল আলম সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে চাচা মামীমকে ড্রাগ লাইসেন্স ও প্যাথেড্রিনের লাইসেন্স বাগিয়ে দেয়। মামীম জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলে সেভেন স্টার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের প্রধান মামীম সিদ্দিকী। প্রচার রয়েছে, সেভেন স্টার সিন্ডিকেটের ইশারা ছাড়া হাসপাতাল এরিয়ায় গাছের একটা পাতাও নড়ে না। সিন্ডিকেটটি জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসকে বগলদাবায় রেখে প্রতিটি সেক্টর থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।

নাজমুলের লন্ডনে একাধিক ব্যবসা ছাড়াও নিজ এলাকা জামালপুরেও রয়েছে নামে-বেনামে অসংখ্য স্থাপনা, মার্কেট ও জায়গা-সম্পত্তি। তার গ্রামের বাড়ি শহরের পাথালিয়ায় নিজের ও চাচা মামীম সিদ্দিকীর রয়েছে আলিশান বাড়ি। শহরের সকাল বাজারে ৫ তলা বিশিষ্ট জান্নাত ট্রেড সেন্টার কিনে নিয়ে নাম দেয় সিদ্দিকী প্লাজা। মেডিকেল রোডে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শফিক সালেহ গেন্দার মালিকাধীন ৪ তলা বিশিষ্ট ডা. বয়েজ উদ্দিন কমপ্লেক্স কিনে নেয়। পোস্ট অফিসের পেছনেও সম্প্রতি কিনেছেন একতলা বাড়িসহ মূল্যবান সম্পত্তি। শহরতলির কাজীর আখেও রয়েছে কয়েক একর জমি। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে খামার। এছাড়া স্টেশন রোডেও রয়েছে তার ৩ তলা বিশিষ্ট আরেকটি মার্কেটসহ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। এসব স্থাপনা ও সম্পত্তির সিংহভাগই চাচা মামীমের নামে করা হয়েছে। তার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের নামেও বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছে নাজমুল। জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের একাধিক দলিল লেখক জানিয়েছেন, তল্লাশি চালালে সিদ্দিকী নাজমুল আলম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত চাচা মামীম ও স্বজনদের নামে বহুসংখ্যক দলিল পাওয়া যাবে।

নাজমুলের চাচা আশরাফুল আলম সিদ্দিকী মামীম তার নামে নাজমুলের সম্পদ ক্রয় অস্বীকার করে  বলেন, আমি নিজেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ছেলে বাবার নামেই সম্পদ ক্রয় করে না, চাচার নামে কিনবো? আমার নামে ওঠা অভিযোগ অসত্য। সিদ্দিকী নাজমুল আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সিদ্দিকী নাজমুল আলমের দেশে-বিদেশে সম্পদের উৎস ও পরিমাণের তথ্য অনুসন্ধানে মাঠে নামার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই অল্প সময়ে ধনকুবের নাজমুলের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ নিয়ে  আড়ালে আবডালে কানাঘুষা শুরু করেছে স্থানীয়রা। তবে তার রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে সরাসরি মুখ খুলছে না কেউ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads