• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
গুইমারায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাসিনো ‘শিলং তির’

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

গুইমারায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাসিনো ‘শিলং তির’

  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর ২০১৯

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির ভারতীয় সীমান্তবর্তী উপজেলা গুইমারায় গ্রামে গ্রামে ‘শিলং তির’ নামে এক প্রকার অনলাইন জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝে কিছুদিন সীমিত আকারে চললেও ফের জোরালোভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সীমান্তের ক্যাসিনো নামে পরিচিত এই ‘শিলং তির’। বর্তমানে এ ব্যাধিটি সামাজিক ক্যানসারের রূপ নিয়েছে। স্কুলপড়ুয়া থেকে শুরু করে প্রান্তিক কৃষকরাও এই জুয়ায় আসক্ত হয়ে লাখ লাখ টাকা হারাচ্ছেন। এমনকি গ্রামের সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালি নারীরাও এ জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। গেল দুবছরের ব্যবধানে গুইমারা উপজেলার অন্তত ১৫ স্থানে ভয়ংকরভাবে এ জুয়ার আসরের বিস্তৃতি ঘটেছে। সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ‘শিলং’ নামক স্থান থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে এ জুয়াটি পরিচালিত হয় বিধায় এটি ‘শিলং তির’ খেলা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ভাবছেন কীভাবে সম্ভব? ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যাভিত্তিক চলে এই জুয়া। এটি একটি কৌশলগত অনলাইনভিত্তিক জুয়া। সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার দুষ্টচক্রের একটি বিরাট মরণফাঁদ। বিশেষ কৌশলের এ জুয়াটির ফাঁদে অনেকে পা দিয়ে অর্থ হারানোর কারণে পরিবারিক অসচ্ছলতা, ঋণগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে স্ত্রী-সন্তান রেখে এলাকা থেকে পালানোর খবরও পাওয়া গেছে। অনেক পরিবারে দেখা দিয়েছে পারিবারিক সংকট ও অশান্তি। জুয়ার আকর্ষণ রাখতে এবং জুয়ার আসর থেকে সাধারণ মানুষ যাতে মুখ ফিরিয়ে না নেন, সেজন্য প্রতিদিনই কয়েকজনকে নামে মাত্র বিজয়ী ঘোষণা করে। হাতেগোনা কয়েকজন জুয়ার আসর থেকে হাসিমুখে ফিরলেও সিংহভাগই ফিরেন নিঃস্ব হাতে। ৮০ গুণ লাভের লোভের এ জুয়ায় ১০ টাকায় ৮০০ টাকা, ২০ টাকায় ১৬০০ টাকা পাওয়ার আশায় নতুন ধরনের এই জুয়ায় রিকশাচালক, দিনমজুর শ্রেণির লোকরাই বেশি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বিশেষভাবে এজেন্ট নিয়োগ করে এ জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করা হয়ে থাকে। গুইমারা উপজেলায় শিলং-এর এজেন্ট পয়েন্ট কমপক্ষে ১৫টি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বটতলী, যৌথখামার, আমলীপাড়া, হাজীপাড়া, দেওয়ানপাড়া, হাতিমুড়া, রামছুবাজার ডাক্তারটিলার নিচে, নতুনপাড়া, বুধংপাড়া, বরইতলী প্রভৃতি। প্রত্যেকটি স্পটে স্থানীয় চতুর একজন লোক মূল হোতাদের পক্ষে  এজেন্ট  হিসেবে এ জুয়া পরিচালনা করেন। এসব এজেন্ট হাজার টাকার জুয়া বাজির কমিশন হিসেবে মূল কোম্পানির কাছ থেকে পায় ৬০ টাকা। সকাল ৯টায় শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত এসব এজেন্টের মাধ্যমে কর্তন করা জুয়ার টাকা ও নম্বর  সাড়ে তিনটার মধ্যেই পৌঁছে দিতে হয় প্রধান এজেন্টদের কাছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এর প্রধান দায়িত্বে রয়েছে তিনজন। তাদের পরিচালিত ‘শিলং তির’ জুয়ার আসর এখন প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় চলে। তাদের অবস্থান সদর উপজেলা থেকে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী বটতলী এলাকায়।  জানা যায়, সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে এ জুয়া চালিয়ে এখন ওরা বিত্তশালী হয়ে উঠেছে। ভারতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববার ছাড়া বাকি ৬ দিনই জুয়ার এ আসর বসে। গুইমারায় আইনশৃঙ্খলা সভাসহ বিভিন্ন সভা সমাবেশে শিলং তির জুয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও বন্ধের বিষয়ে যথাযথ কোনো কার্যক্রম এখনো দেখা যায়নি। সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন শিলং জুয়ার মূল হোতারা। অভিযোগ উঠেছে, কিছু অসাধু প্রশাসনিক কর্তা ও প্রভাবশালীকে ম্যানেজ করে এ জুয়া খেলা চলে আসছে। এই জুয়া প্রচলনের প্রথম দিকে এলাকার বেকার বা আড্ডাবাজ তরুণ যুবকদের টার্গেট করা হলেও বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও নারীরাও আসক্ত হয়ে পড়েছেন এ খেলায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসার সময় টিফিনের টাকা শলিংয়ের  বাজিতে রেখে আসছে লাভের আশায়। গেল কয়েক বছর ধরে গুইমারা এলাকার আনাচে-কানাচে এই জুয়া খেলা চলছে। মাঝে প্রশাসনের তৎপরতায় কিছু দিন কমছিল। গত দুই মাস বটতলী এলাকার প্রভাবশালী নতুন এজেন্টের মাধ্যমে বেশ জোরালো পরিসরে চলছে এ জুয়াটি। কয়েকজন জুয়াড়ির দেওয়া তথ্যমতে আগে শুধু  গুইমারা উপজেলাতেই শিলংয়ের দৈনিক বাজি লাগানো হতো ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে এই বাজির পরিমাণ ৬-৭ লাখ টাকায় পৌঁছেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কার্বারি, হেডম্যান ও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি জানিয়েছেন, গুইমারা উপজেলায় শিলং তির জুয়ার মূল হোতার বাড়ি তাদের বটতলী এলাকায়। গত দুমাস এ খেলা চালিয়ে হঠাৎ দুটি পিকাপ গাড়িসহ বিপুল টাকার মালিক বনে গেছে সে। হাফছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান চাইথোয়াই চৌধুরী জানান, খেলাটি বন্ধের বিষয়ে তিনি সামাজিকভাবে চেষ্টা চালিয়েছেন। তবে এ জুয়ার কারণে নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। এ বিষয়ে গুইমারার এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, শিলং তো শুধু জুয়া নয়, এটি একটি মানি লন্ডারিং। আমাদের দেশের টাকা বাইরে পাচার হচ্ছে। এত আলোচনার পরও কেন শিলং নামক জুয়াটি বন্ধ করা যাচ্ছে না তা তার বোধগম্য নয়।

স্থানীয় সমাজকর্মী অংথোয়াই মার্মা অভিযোগ করেছেন, এসব জুয়াড়ির কারণে এলাকায় অস্থিরতা বাড়ছে। উঠতি বয়সী তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে। সামাজিক সংকট দেখা দিচ্ছে। টাকাপয়সাসহ সর্বস্ব লুটে  ধীরে ধীরে নিঃস্ব করে দিচ্ছে পরিবারকে। এখনই জুয়ার র্কাযক্রম বন্ধ হওয়া উচিত। শিলং তির পরিচালনায় জড়িত কয়েকজন এজেন্টের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় রামছুবাজার জৈবসার উৎপাদনকারী ক্লাবে ৭৮ লাখ টাকার জুয়া চলে। প্রশাসন আগে সেট বন্ধ করুক বাকিটা পরে দেখা যাবে। এদিকে উপজেলার রামছুবাজার জৈবসার উৎপাদনকারী ক্লাবে লটারির নামে চলছে ৭৮ লাখ টাকার জুয়া। ভাগ্য পরীক্ষার নামে সপ্তাহে ৩ হাজার গ্রাহক থেকে ১০০ টাকা হারে ৩ লাখ টাকা এবং বছরে ২৬ সপ্তাহে ৭৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে চলছে এ লটারি। স্থানীয় ভুক্তভোগীরা জানান, নামকরা লোকদের নিয়ে একটি পরিচালনা কমিটি আছে। তাদের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী বিশেষ ব্যক্তিদের ছায়া। এ কারণে স্থানীয়রা ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করে না। প্রতি রোববার বিকেল ৩টায় ওই সার উৎপাদনকারী ক্লাবে লোভনীয় পুরস্কারের নাম প্রদর্শন করে ড্রতে দেওয়া হয় ২/৩ হাজার টাকা দামের সামগ্রী। রীতিমতো প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এ অবৈধ লটারি। ইতঃপূর্েবও দেওয়ানপাড়া ক্লাব ও সিন্দুকছড়িতে এ ধরনের লটারির নামে জুয়া চালিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

তবে লটারির নামে জুয়ার কোনো ধরনের অনুমতি না থাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে এলাকায়।  এ বিষয়ে গুইমারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিদ্যুৎ বড়ুয়া জানান, শিলং তির জুয়াটি বন্ধে তিনি বেশ তৎপর রয়েছেন। জৈবসার উৎপাদনকারী ক্লাবের লটারি বন্ধে ইতোমধ্যে নির্েদশ দিয়েছেন। তিনি আশা করছেন দ্রুত এ জুয়া গুলো বন্ধ করা সম্ভব হবে।

গুইমারা (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি হ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads