• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

হোটেল বয় থেকে শতকোটি টাকার মালিক মিজান

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০১৯

জীবিকার তাগিদে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে হোটেল বয় হিসেবে জীবিকা শুরু করেন হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান। ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির মাধ্যমে অপরাধজগতে হাতেখড়ি হয়। এরপর যুবলীগ নেতা সম্রাটের সান্নিধ্যে আরো বেপরোয়া ওঠেন তিনি। ক্যাসিনো ব্যবসা, চুরি, ছিনতাই, খুন-জখম, দখলদারিত্বসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে সামান্য হোটেল বয় থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও নির্বাচিত হন হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ায় সীমান্ত এলাকা হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে গত শুক্রবার ভোরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এক বান্ধবীর বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি ও নগদ ২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে ওইদিন বিকালে মোহাম্মদপুরে তার বাসায় অভিযান চালায় র্যাব সদস্যরা। এ সময় তার বাসা থেকে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক, এক কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার করা হয়। গতকাল শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা এবং শ্রীমঙ্গলে র্যাব বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে।

র্যাব-২-এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানের বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গলে অস্ত্র আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গনেশ গোপাল বিশ্বাস বলেন, র্যাব বাদী হয়ে কাউন্সিলর মিজানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা (নম্বর-৩১) দায়ের করেছে।

এদিকে র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আবদুল জব্বার বাদী হয়ে গতকাল শনিবার শ্রীমঙ্গল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। মামলা নম্বর-১৫। গতকাল দুপুরে মানি লন্ডারিং মামলায় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসির আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসি  মিজানের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে মোহাম্মদপুরে গড়ে তোলেন অপরাধের সাম্রাজ্য। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, টেন্ডারবাজির মাস্টার হিসেবে বেশ সুপরিচিত তিনি। নিজের কোনো ব্যবসা নেই, তবুও দেশে-বিদেশে রয়েছে তার কোটি কেটি টাকার সম্পত্তি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মিজানের আলিশান দুটি বাড়ি ও দামি গাড়ি থাকার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে র্যাব-২-এর অধিনায়ক আশিক বিল্লাহ জানান, কাউন্সিলর মিজানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনাকারীদের সঙ্গে মিজানের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার এড়াতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন মিজান। এ জন্য গত মঙ্গলবার  তিনি ঢাকা ছেড়ে শ্রীমঙ্গলে চলে যান। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার মিজান ব্যাংক থেকে ৬৮ লাখ টাকা তুলেছিলেন। তবে সেই টাকা কোথায় রেখেছেন সেটি স্বীকার করেননি।

র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম বলেন, কাউন্সিলর মিজানের বাসায় অভিযান চালিয়ে ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের ৮টি চেক পাওয়া যায়। এ ছাড়া ৩টি এফডিআর মিলে মোট ১ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির জমি দখলে সহায়তার জন্য এসব চেক তাকে দেওয়া হয়েছিল।

সারোয়ার আলম আরো বলেন, গত ১৫ বছর ধরে মিজানের নিজস্ব কোনো ব্যবসা নেই। কাউন্সিলর হিসেবে যে সম্মানী (৩৬ হাজার টাকা) পান সেটিই তার একমাত্র আয়ের উৎস। তবে উদ্ধার হওয়া কোটি টাকা ও বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কীভাবে হয়েছে মিজানের? আমরা ধারণা করছি, এসব সম্পত্তি তিনি অবৈধ অর্থ দিয়ে গড়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাউন্সিলর মিজান মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের কাছে ত্রাস হিসেবে পরিচিত। তাকে পাগলা মিজান নামে সবাই চেনে। মোহাম্মদপুরে অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতা ছিলেন এই কাউন্সিলর। তার কারণে মোহাম্মদপুরে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ক্ষমতার জোরে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেত।

জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাউন্সিলর মিজান জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করত। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বিভিন্ন বড় বড় হোটেলে মিটিং করতেন, আড্ডা দিতেন। ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দৈনিক ৩০ হাজার টাকা নিতেন মিজান। আর এই টাকা তোলার কাজে নিয়োজিত ছিল মর্তুজা, জিলানীসহ কাউন্সিলরের লোকজন। এ ছাড়াও টোল মার্কেটের একক নিয়ন্ত্রক ছিল মিজানের। ক্যাম্পের বিদ্যুতের সংযোগ দুটি ভাগে ভাগ করে একটি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দেওয়া হয় এবং অপরটি ক্যাম্পের বাজারে সংযোগ দেওয়া হয়। প্রায় ২৫০টি দোকান থেকে বিদ্যুতের টাকা তুলতেন তিনি। এতে তার প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় ছিল।

জানা গেছে, হাবিবুর রহমান মিজানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় ফ্রিডম পার্টির মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের পর মিজানুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান নাম পাল্টে হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মিজান।

আওয়ামী লীগ এবং মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৫ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর মিজান হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। বাড়ি দখল, জমি দখল, খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনেক অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। রাতারাতি বনে যান কোটিপতি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, দলের কেউ তার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করত না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মিজান কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তবে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কোনো পদে মিজান নেই বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান বলেন, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। যার যার নিজের কর্মকাণ্ডের ভার তাকেই বহন করতে হয়। হাবিবুর রহমান মিজান এক সময় মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকলেও তিনি এখন আর আওয়ামী লীগের কেউ নন।

জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর খামারবাড়ি খেজুরবাগান এলাকায় ছিনতাই করতে গেলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়া মসজিদের পাশের পুকুরে নেমে পড়েন মিজান। যাতে পুলিশ কাছে আসতে না পারে সেজন্য কাপড় ছাড়াই ওপরে উঠে আসেন। তার এ ধরনের কাজের জন্য পুলিশ তাকে ‘পাগলা’ আখ্যা দেয়। তখন থেকেই এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে ‘পাগলা’ মিজান নামে।

অনেক অপরাধের নায়ক মিজানের নামে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা ও ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে একাধিকবার গ্রেপ্তার হন এই মিজান। মোহাম্মদপুর এলাকায় ভূমিদস্যু হিসেবেই তাকে চেনে সবাই। এ ছাড়া ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ ও তার স্ত্রী ময়িম বেগমকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করেন তিনি। তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে এ ঘটনায়ও পার পেয়ে যান। জমি দখলকে কেন্দ্র করে গত বছর একদল সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানসংলগ্ন তুরাগ নদের ওপারে একটি রিয়েল এস্টেটের ছয় কর্মীকে গুলি এবং আরো ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়। এ হত্যার নেপথ্যেও মিজানকে দায়ী করা হয়। মিজান শ্যামলী মাঠের পশ্চিম পাশের জমির একাংশ দখল করে বানিয়েছেন মার্কেট। সেখানে তিন শতাধিক ঘর তুলে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads