• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে তিনি

জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম

ছবি : সংগ‍ৃহীত

অপরাধ

রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে তিনি

চীনা কোম্পানিকে ১৮৬ কোটি টাকা তসরুপের সুযোগ

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশেষ ছাড় দিয়েছেন বিদেশি কোম্পানিকে। তার নির্দেশে চুক্তি লঙ্ঘন করে একের পর এক একটি চীনা কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে এই দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) চীনা ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামকে ১৮৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিনব এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন সরকারের এই আমলা।

সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের নির্দেশে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ ছাড় করা হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত বৈঠকের সারসংক্ষেপ পত্রে বলা হয়, চুক্তি নং বিসিএমসিএল/ ০৬/১৩৪/ ২০১১-এর  সমাপ্তিকরণ ও রিটেনশন মানি ফেরত প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বোর্ড সভায় উপস্থাপনের জন্য সচিব মহোদয় মৌখিক নির্দেশনা প্রদান করেন।’ এর ভিত্তিতে বোর্ড সভায় উল্লেখিত বিপুল পরিমাণ অর্থ চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে রিলিজ (ছাড়) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত ও দুর্নীতির শামিল।

জানতে চাইলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের খবরকে আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম  বলেন, আমি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। দেশের স্বার্থ রক্ষা করা আমার নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব। আমার দ্বারা দেশের কোনো ক্ষতি হবে এমনটি আমি চাইতেই পারি না। জনগণের করের টাকায় আমার বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়। আনীত অভিযোগটি ঠিক নয়। আমার পেশাগত জীবনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছি। এই মন্ত্রণালয়ে এসেও জ্বালানি খাতে যাতে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা নষ্ট না হয়, সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। 

সূত্র জানায়, কথা ছিল চুক্তি শেষে ‘স্কোপ অব ওয়ার্ক’ অনুযায়ী সব ধরনের দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করে ঠিকাদারকে টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু চুক্তি লঙ্ঘন করে পুরো টাকা দিয়ে দিয়েছে বিসিএমসিএল। টাকা পরিশোধের আগে চীনা কনসোর্টিয়ামের বিভিন্ন বিল নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জিওলজিক্যাল সার্ভে বাংলাদেশের (জিএসবি) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ নিহাল উদ্দিনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার তদন্তেও এই বিল ও জামানত নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

কোম্পানির ২৮৯তম পরিচালনা পর্ষদ সভায়ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোল ইয়ার্ডে মজুদকৃত কয়লার মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন চুরির বিষয়ে গঠিত কমিটিগুলোর দাখিল করা প্রতিবেদন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে প্রাপ্তির পর সুপারিশ মোতাবেক পরবর্তী বোর্ড সভায় এই টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু তা না করে ১৯০তম সভায় চীনের ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামকে পুরো টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, চীনা ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকার পরও সেগুলো নিষ্পত্তি না করেই আগেভাগে তাদের সঙ্গে তৃতীয় দফায় চুক্তি করা হয়েছে।

অনেকটা বেআইনিভাবে এসব চুক্তিতে সায় দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব। তার মৌখিক নির্দেশে বিসিএমসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান ১৮৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। ফজলুর রহমান বর্তমানে পেট্রোবাংলার জেনারেল ম্যানেজার (মাইনিং) হিসেবে কমর্রত আছেন।

জানা গেছে, চীনের এই কোম্পানিসহ বিসিএমসিএলের বিরুদ্ধে ২১২ কোটি টাকার ১ লাখ ৮৫ হাজার টন কয়লা চুরির অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। এছাড়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার ৮০৫ টন বেশি কয়লা উৎপাদনের বিষয়টিও সুরাহা হয়নি। চুক্তিকালীন চীনা কোম্পানি যেসব কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ (এলডি) আদায় করা হয়নি।

নিয়ম অনুযায়ী চুরির মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর এবং এসব অভিযোগের তদন্ত শেষে এই টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে উল্টো চীনা কোম্পানিকে অতিরিক্ত বিলসহ প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা প্রদান করা হয়।

চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বড়পুকুরিয়া কয়লা কোম্পানির চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আর্দ্রতার (পানি) পরিমাণ ৫ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এর বেশি থাকলে বাড়তি পানির দাম বাদ দিয়ে চীনা কোম্পানিকে কয়লার দাম পরিশোধ করার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, সরবরাহ করা কয়লায় এর চেয়ে অনেক বেশি পানি ছিল।

চীনা কোম্পানিকে এই বাড়তি পানির দাম বাদ না দিয়ে কয়লার দামে এই পানির মূল্যও দিয়েছে বড়পুকুরিয়া কর্তৃপক্ষ। কোম্পানিটির বেশিরভাগ কর্মকর্তা বিষয়টির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত চীনা কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত আগের চুক্তির (ক্লোজিং অব কন্ট্রাক্ট) বাকি বিল এবং রিটেনশন মানি আটকে রাখতে বলেছিলেন।

জানা গেছে, এই বিল প্রদানের জন্য বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে গত ৬ মার্চ জ্বালানি সচিবের নেতৃত্বে পেট্রোবাংলায় একটি বৈঠক করেন ফজলুর রহমান। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যান নিজে ও সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads